Thursday, December 20, 2012

গোলাম আযম কি ভাষাসৈনিক ছিলেন?

গোলাম আযম কি ভাষাসৈনিক ছিলেন?

আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী 

 

গোলাম আযম ভাষাসৈনিক হলে ভাষাশহীদদের স্মরণে নির্মিত ঢাকার শহীদ মিনার বর্বরোচিতভাবে ভাঙার কাজে তার দল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়তা ও সমর্থন জোগাতে পারত না। কামান দেগে শহীদ মিনারটি ভাঙার পরই জামায়াতিরা ওই ভগ্ন ও বিধ্বস্ত শহীদ মিনারে গিয়ে উপস্থিত হয় এবং শহীদ মিনারকে মসজিদ ঘোষণা করে সেখানে নামাজ পড়ার জন্য একত্র হতে শহরবাসীকে আমন্ত্রণ জানায়। শহীদ মিনারটিকে এভাবে শহীদ করার প্রয়াসের সময় গোলাম আযম কোথায় ছিলেন?

ঢাকার দৈনিক ইত্তেফাকের ২২ ফেব্রুয়ারির সংখ্যাটি লন্ডনে আমার হাতে দেরিতে এসেছে। তাই দুটি মজার খবর আমার চোখে দেরিতে পড়েছে। একটি খবর হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এম এমাজউদ্দীন আহমদ সাহেবের একটি প্রতিবাদপত্র; অন্যটি হলো, একুশে ফেব্রুয়ারির দুপুরে ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে মহানগর জামায়াতের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক একেএম নাজির আহমদের বক্তব্য। দু'জনেই উচ্চশিক্ষিত। কিন্তু তথ্য বিকৃতি বা বিস্মৃতির ক্ষেত্রে দেখলাম দু'জনেই দু'জনের পরিপূরক। তাদের একজন বিএনপি ঘরানার এবং অন্যজন জামায়াতি ঘরানার মানুষ।

অধ্যাপক এমাজউদ্দীন দৈনিক ইত্তেফাকে ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে তার বক্তব্য বলে যে কথা প্রকাশিত হয়েছে, তার প্রতিবাদ করে বলেছেন, 'যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারকৃত গোলাম আযমকে ভাষাসৈনিক অভিহিত করে তার ওপর জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর যে আহ্বান তিনি জানিয়েছেন বলে ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়েছে, তা তিনি বলেননি। তবে তিনি গোলাম আযমকে ভাষাসৈনিক বলেছেন।'

কেন বলেছেন, তার ব্যাখ্যা এই প্রতিবাদপত্রে তিনি দিয়েছেন। বলেছেন, '১৯৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকিস্তান সফরে আসেন। এই সময় গোলাম আযম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়ন বা ডাকসুর জিএস হিসেবে ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি সংক্রান্ত মানপত্র পাঠ করেন। এ জন্য তাকে আমি ভাষাসৈনিক হিসেবে অভিহিত করেছি।' অধ্যাপক সাহেবের এই বয়ানকে আমি কেন দুটি মজার খবরের একটি বলে অভিহিত করেছি, সে কথায় পরে আসছি।
দ্বিতীয় মজার খবরটি হলো, জামায়াত কর্তৃক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠান এবং তাতে প্রধান অতিথি অধ্যাপক নাজির আহমদের দেওয়া বক্তব্য। এই অধ্যাপক সাহেবও বলেছেন, '১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল ভাষাগত মানবাধিকারের সংগ্রাম। আর সে আন্দোলনে যারা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের মধ্যে যারা এখনও জীবিত আছেন তাদেরই একজন হচ্ছেন জামায়াত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম।' ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবে জামায়াতের নায়েবে আমির সাহেব যখন এই বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন আমি সেই সভায় হাজির থাকলে বলতাম, 'বাচ্চিয়া লোগ্, তালিয়া বাজাও।'

আগে এমাজউদ্দীন সাহেবের কথায় আসি। ১৯৪৮ সালের ২৭ নভেম্বর বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য ঢাকার ছাত্র সমাজের দাবি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীকে দেওয়া মানপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল বলে তিনি বলেছেন। গোলাম আযম ডাকসুর জিএস হিসেবে পদাধিকারবলে এই মানপত্রটি মাত্র পাঠ করেছিলেন। তাতেই এমাজউদ্দীন সাহেবের চোখে গোলাম আযম ভাষাসৈনিক হয়ে গেছেন। বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবী বা শিক্ষাবিদের চোখে তা হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ, ১৯৭১ সালে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার ট্রান্সমিশন কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা মাত্র পাঠ করেই এই অধ্যাপক সাহেবদের কাছে 'স্বাধীনতার ঘোষণাকারী' হয়ে গেছেন। সেখানেও তাকে সেনাবাহিনীর একজন মেজর হিসেবে এই ঘোষণাটি পাঠ করার জন্য আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা এবং ওই বেতার কেন্দ্রের কর্মীরাই ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন।
গোলাম আযমও ১৯৪৮ সালে ডাকসুর জিএস হিসেবে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীকে দেওয়া মানপত্র পাঠ করতে গিয়েছিলেন। ভাষার দাবি জানাতে যাননি। ওই দাবিটিও গোলাম আযম নিজে মানপত্রে ঢোকাননি। ডাকসুর অন্য কর্মকর্তারা সরকারপন্থি ছাত্রদের বিরোধিতার মুখে মাত্র এক লাইনে ওই দাবিটি ঢোকাতে পেরেছিলেন।

ওই এক লাইনের দাবিটি কী ছিল বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র করার? তাও নয়, আমাদের অনেক প্রখ্যাত ভাষা-ইতিহাসবিদ ভুলে গেছেন, ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাকে দেশের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিটি ওঠেনি। তখন দাবিটি ছিল, বাংলাকে প্রদেশের (পূর্ব পাকিস্তানের) সরকারি কাজকর্মের দাফতরিক ভাষা করা হোক। পাকিস্তানের দুই অংশেই উর্দু থাকবে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হিসেবে। অর্থাৎ বনামে দেশের কেন্দ্রীয় ভাষা। বাংলাকে তার সমমর্যাদার রাষ্ট্রীয় ভাষা করার দাবি তখনও ওঠেনি। পাকিস্তান হওয়ার পর বাংলাভাষা সম্পর্কে প্রাথমিক দাবি ছিল তাকে প্রদেশের সরকারি কাজকর্মের ভাষা করার। স্বায়ত্তশাসনের দাবি থেকে যেমন পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপিত হয়, তেমনি বাংলাকে প্রাদেশিক ভাষা করার দাবি ধীরে ধীরে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পরিণত হয়।

১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহ মারা যান। তখন পর্যন্ত দৈনিক আজাদ কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হতে পারেনি। সম্ভবত পরের বছর হয়েছিল। তখন ঢাকার বংশাল রোড থেকে 'দৈনিক জিন্দেগী' নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। সম্পাদক ছিলেন এসএম বাবলুল হক ও কাজী আফসারউদ্দীন আহমদ। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর 'জিন্দেগীই' ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র।

এই জিন্দেগী পত্রিকায় লিয়াকত আলীর ঢাকা সফরের সময় তাকে দেওয়া ডাকসুর মানপত্রের কথা খবরে উল্লেখ করা হয়েছিল। তাতে মাত্র এক লাইনে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া মানপত্রে ছাত্রসমাজ বাংলাকে প্রদেশের সরকারি কাজকর্মের ভাষা করার দাবি করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। এই মানপত্রটি যদি আজ খুঁজে পাওয়া যেত, তাহলে আমাদের চক্ষু-কর্ণের বিবাদ দূর হতো। এটা স্পষ্ট হয়ে যেত, বাংলাকে ওই মানপত্রে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়নি। করা হয়েছিল প্রাদেশিক সরকারি কাজকর্মের ভাষা করার।

মানপত্রে এই এক লাইনের একটি দাবি পাঠ করে গোলাম আযম ভাষাসৈনিক হয়ে গেলেন? যেমন হয়েছিলেন জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক। বাংলার ইতিহাসে এই জাতীয় কাকতালীয় ঘটনাগুলো মজার ব্যাপার ছাড়া আর কী হতে পারে? এবং যখন তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের পদ একসময় অধিকার করেছিলেন, এমন ব্যক্তিদের মুখ থেকে বেরোয় তাকে দুঃখজনক মশকরা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে?

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বছর না ঘুরতেই পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাভাষার আন্দোলন শুরু হয় মূলত ছাত্রদের দ্বারা। ঢাকার রেসকোর্সের ময়দানে জিন্নাহ কর্তৃক উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা এই আন্দোলনকে প্রকাশ্য রূপ দেয়। ছাত্র আন্দোলনের সামনে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকার নতি স্বীকার করে। তখন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দীন। তিনি ছাত্র নেতাদের সঙ্গে একটি লিখিত চুক্তি করেন। তাতে বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক ভাষা করার জন্য প্রাদেশিক পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন ও তা পাস করানোর প্রতিশ্রুতি দেন। পরে তিনি এই ওয়াদা ভঙ্গ করেন।

এই পর্যায়ের ভাষা আন্দোলনেও জোরালো সমর্থন ছিল তমদ্দুন মজলিসের। জামায়াত ১৯৪৮ সাল থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু করলেও ভাষা আন্দোলনে কখনও যুক্ত হয়নি। আর গোলাম আযম যখন লিয়াকত আলীর জন্য মানপত্রটি পাঠ করেন, তখনও তিনি জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত হননি। ভাষা আন্দোলনের সামনের কাতারের নেতা ছিলেন আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, গাজীউল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা প্রমুখ।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার আগে পর্যন্ত ১৫ মার্চ ছিল ভাষা আন্দোলন দিবস। এই আন্দোলনে কাজী গোলাম মাহবুব, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ সকলকেই গ্রেফতার বরণ করতে হয়েছে। আবদুল মতিনকে হুলিয়া মাথায় করে আন্ডারগ্রাউন্ডেও পালিয়ে থাকতে হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীনের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের ভাষার দাবির স্মারকলিপি নিয়ে গিয়েছিলেন সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন ভিপি আবদুর রহমান চৌধুরী (পরে বিচারপতি হয়েছিলেন)। তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের এই প্রথম পর্যায়েও গোলাম আযমকে কোথাও দেখা যায়নি। তাকে গ্রেফতার হতে হয়নি। ভাষা আন্দোলনকারীদের সচিবালয় ঘেরাও বা রাজপথের মিছিলেও গোলাম আযমকে দেখা যায়নি। ১৫ মার্চের ভাষা দিবস উদযাপনের কোনো বছরের সভায় তাকে দেখা যায়নি। ভাষাসংগ্রাম কমিটিতেও (কেন্দ্রীয় অথবা ছাত্র কমিটি) তার নাম দেখা যায় না। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আরোপিত ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য ভাষা আন্দোলন_ সংযুক্ত প্রবীণ ও নবীন নেতাদের কোনো গোপন ও প্রকাশ্য সভাতেই তাকে অংশ নিতে দেখা যায়নি। তাহলে তিনি ভাষাসৈনিক হলেন কীভাবে? কেবল ১৯৪৮ সালে লিয়াকত আলীর ঢাকা সফরের সময় এক্সিডেন্টলি একটি মানপত্র পাঠ দ্বারা ভাষাসংগ্রামী, ভাষাসৈনিক হয়ে গেলেন? ইতিহাস বিকৃতি এবং মিথ্যা দাবি করারও একটা সীমা থাকা দরকার।

একুশের মর্মান্তিক রক্তাক্ত ঘটনার পর ভাষাশহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের (বর্তমান শহীদ মিনার সংলগ্ন ব্যারাক ঘর) প্রাঙ্গণে। মওলানা ভাসানী তাতে ইমামতিত্ব করেন। ভাষা আন্দোলনের তৎকালীন অধিকাংশ নেতা তাতে যোগ দেন। এই জানাজা-পরবর্তী শোক মিছিলের অগ্রভাগ যখন সদরঘাটে পেঁৗছে গেছে, তখনও তার শেষের অংশ কার্জন হলের মোড়েই রয়ে গিয়েছিল। গোলাম আযম তখন কোথায় ছিলেন?

এরপর প্রতিবছর অমর একুশের স্মরণে ঢাকার রাস্তায় প্রভাতফেরি বেরিয়েছে। মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুরসহ আন্দোলনের অধিকাংশ নেতাকে এই প্রভাতফেরির সামনের কাতারে দেখা গেছে। আজিমপুর গোরস্তানে গিয়ে তারা কয়েকজন শহীদের সমাধি জিয়ারত করেছেন। পুষ্পমাল্য অর্পণ করেছেন। ভাষা দিবসের এই দীর্ঘ ৬০ বছরের ইতিহাসে গোলাম আযমকে কখনও প্রভাতফেরিতে, শহীদদের গোরস্তানে অথবা মিছিলে দেখা গেছে কি? যুদ্ধের ময়দানে নেই। অথচ তিনি সবচেয়ে বড় যোদ্ধা। এমাজউদ্দীন ও নাজির আহমদ সাহেবের কথা শুনে হাসব, না কাঁদব?
এই মহান ভাষাসৈনিকের পরবর্তী ইতিহাস হচ্ছে, জামায়াতে যোগ দেওয়ার পর তিনি করাচি সফরে গিয়ে এক সভায় বলেন, 'তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে, বাংলাভাষার আন্দোলনে অল্প সময়ের জন্য হলেও সমর্থন দিতে যাওয়া। এ জন্য তিনি এখন অনুতপ্ত।' তার এই বক্তব্য সে সময় ঢাকার আজাদ এবং মর্নিং নিউজ দুটি কাগজেই ছাপা হয়েছিল। গোলাম আযম ঢাকায় ফিরলে তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তিনি বাংলাকে অনৈসলামিক ভাষা মনে করেন কি-না? তিনি জবাব দেননি।

১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরও এই ভাষার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের শাসকদের ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি। মুসলিম লীগ আমলে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। আইয়ুব আমলে রোমান হরফে বাংলা লিখে রোমান বাংলা প্রবর্তনের চেষ্টা হয়েছিল। এই দুই ষড়যন্ত্রের সময়ই ড. শহীদুল্লাহ থেকে মুনীর চৌধুরী অর্থাৎ অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো এর বিরুদ্ধে জোর আন্দোলনে নেমেছে। গোলাম আযম ও জামায়াতের অবস্থান তখন কী ছিল? এই ভাষা রক্ষার ধারাবাহিক আন্দোলন ও সংগ্রামগুলোর কোনোটাতেই গোলাম আযমের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ কোনো ভূমিকা কি ছিল? তার ও তার দলের ভূমিকা সবসময়ই কি বাঙালির সেক্যুলার ভাষা-সংস্কৃতির বিরোধিতাকারীর ভূমিকা ছিল না?

জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক নাজির আহমদ বলেছেন, 'বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল ভাষাগত মানবাধিকারের সংগ্রাম।' ভাষা আন্দোলনের আসল সংজ্ঞাটি এখানে কৌশলে ঢাকা দিতে চাচ্ছেন এই জামায়াতি অধ্যাপক। ভাষাসংগ্রামের সূচনা বাঙালির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সত্তার অস্তিত্ব রক্ষা এবং তার অসাম্প্রদায়িক স্বাধীন জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। এই লক্ষ্যের মধ্যে মানবাধিকারের প্রশ্নটি তো রয়েছেই। এর কোনোটাতেই তো গোলাম আযম বা জামায়াত বিশ্বাস করে না। তাহলে মধ্যযুগীয় তালেবানি বিশ্বাস ছেড়ে তারা সেক্যুলার কালচার ও মানবাধিকারের সংগ্রামে সৈনিক ছিলেন দাবি করেন কীভাবে?

গোলাম আযম ভাষাসৈনিক হলে ভাষাশহীদদের স্মরণে নির্মিত ঢাকার শহীদ মিনার বর্বরোচিতভাবে ভাঙার কাজে তার দল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদারদের সহায়তা ও সমর্থন জোগাতে পারত না। কামান দেগে শহীদ মিনারটি ভাঙার পরই জামায়াতিরা ওই ভগ্ন ও বিধ্বস্ত শহীদ মিনারে গিয়ে উপস্থিত হয় এবং শহীদ মিনারকে মসজিদ ঘোষণা করে সেখানে নামাজ পড়ার জন্য একত্র হতে শহরবাসীকে আমন্ত্রণ জানায়। শহীদ মিনারটিকে এভাবে শহীদ করার প্রয়াসের সময় গোলাম আযম কোথায় ছিলেন? তিনি তখনকার গভর্নর হাউসে টিক্কা খান, রাও ফরমান আলিদের সঙ্গে বৈঠকে বসে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বুদ্ধিজীবীদের হত্যার তালিকা তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। এহেন যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতার জঘন্য শত্রুকে যদি ভাষাসৈনিক সাজাতে হয়, তাহলে বদরুদ্দীন উমরের দ্বারা ভাষা আন্দোলনের অন্য একটি ইতিহাস হয়তো লেখাতে হবে।
[সূত্রঃ সমকাল, ১০/০৩/১২] 

Post Comment

No comments:

Post a Comment