Saturday, May 30, 2020

স্বার্থপরতা


করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত এক জাপানি ব্যক্তি করোনাভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বার ও হোটেলে ঘুরে বেড়িয়েছেন। জাপানের গামাগোরির শহরে এ ঘটনা ঘটেছে। তার বক্তব্য ছিল- একা মরবো কেন? এটি স্বার্থপরতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

স্বার্থপরতার আভিধানিক অর্থ হলো- অপরের ইষ্টানিষ্টের কথা না ভেবে স্বকার্য সাধনে তৎপরতা। ইষ্টানিষ্ট এর আভিধানিক অর্থ হলো- ভালোমন্দ। অর্থাৎ অন্যের ভালোমন্দ না ভেবে শুধুমাত্র নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করা। অন্যকথায়, যে কোন কিছুর বিনিময়ে নিজের স্বার্থ বা লাভ নিশ্চিত করা।

এখন আমরা যদি ভেবে দেখি, আমরা সবাই কি স্বার্থপর নই? আমার ধারণা, ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে আমরা সবাই স্বার্থপর। তবে এতে হয়তো আপেক্ষিকতা বিদ্যমান। কারো কারো স্বার্থপরতা তীব্র, কারো কারো মৃদু। কারো কারো স্বার্থপরতা নগ্ন, আবার কারো স্বার্থপরতায় রাখঢাক বিরাজমান।

যেমন ধরা যাক, আমরা কোন একটি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেলাম। ঐ প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন থেকে অনেক কিছু শিখলাম, নিজেকে সমৃদ্ধ করলাম। অর্থাৎ সংগঠন থেকে যা যা নেওয়ার ও পাওয়ার, সবকিছু নিলাম ও পেলাম। কিন্তু যখনই সংগঠনের জন্য কিছু করার বা সংগঠনকে কিছু দেওয়ার সময় এলো, তখনই আমরা তুলনামূলক ভালো প্যাকেজে বা ভালো অফারে অন্য প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের সাথে নিজেকে যুক্ত করলাম। আমাদের চলে যাওয়াতে ওই প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের কোন ভালো বা মন্দ ঘটলো কিনা তা দেখার বা ভাবার নূন্যতম ইচ্ছাও আমরা পোষণ করি না, শুধু নিজেদের স্বার্থ বা লাভটাই দেখি। এমনটা অহরহ ঘটছে। প্রায় সকল স্তরের লোক এ ধরনের ঘটনার সাথে অর্থাৎ স্বার্থপরতার সাথে যুক্ত।

কিংবা, যেখানে বিদ্যুৎ বা পানি ব্যবহারের প্রকৃত বিল আমাদের বহন করতে হয় না, সেখানে আমরা অবিবেচক হয়ে যাই; অপচয় করি। এই বিল যে অন্য কাউকে পরিশোধ করতে হবে তা আমরা বেমালুম ভুলে যাই। প্রকৃত বিল পরিশোধ না করার সুযোগ থাকায় মহামূল্যবান প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে কাপড় শুকানো বা একটি মাত্র দেশলাইয়ের কাঠি বাঁচানোর আশে ঘন্টার পর ঘন্টা গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখা কি স্বার্থপরতা নয়?

লোকাল বাসে উঠার সময় আমরা কয়জনই নিজেকে স্থির রাখতে পারি? শুধুমাত্র একটা সিট পাওয়ার আশায় বাহুবলে ধাক্কা দিয়ে অন্যকে গাড়ির চাকার নিচে ফেলে দিতেও আমরা দ্বিধা বোধ করি না।

আমাদের স্বার্থপরতার কোটি কোটি উদাহরণ আছে। এসব আমাদের সবারই জানা আছে। আমি যে তিনটি উদাহরণ দিলাম, তা নিতান্তই সাধারণ ও অতিপ্রচলিত কিছু ব্যাপার। অনেকে হয়তো এসবকে এখন আর স্বার্থপরতা হিসেবে ধরেই না। স্বার্থপরতার সংজ্ঞায় যারা অজ্ঞ, তারাও স্বার্থপরতার চর্চায় বেশ পটু। আমরা নিজেরা যখন অন্যের প্রতি স্বার্থপর হই, তখন আমরা কাকের মতো চোখ বন্ধ করে রাখি। কিন্তু অন্য কেউ যখন আমাদের প্রতি স্বার্থপর হয়, তখন আমাদের নৈতিকতা বোধ প্রকটভাবে জেগে উঠে; আমরা গলা বড় করি ও অন্যদের স্বাক্ষী করি। এই স্বার্থপরতার বন্যায় বর্তমান সমাজে স্বার্থহীন লোক খুঁজে পাওয়া দুস্কর; যাও দু'একজন আছেন তারাও 'সোজা' উপাধি প্রাপ্ত হয়ে কোনরকমে টিকে আছেন।

একজন চেতনা ব্যবসায়ীর কাহিনী শুনলাম কয়েকদিন আগে। এই করোনা-কালে মাথায় কিছুটা কু-বুদ্ধি খাটিয়ে তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করেছেন। উনার পদ্ধতিটি দ্বিমুখী। কূটকৌশল কাজে লাগিয়ে তিনি দুটি গ্রুপ টার্গেট করেছেন। করোনার প্রভাবে কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের সহযোগিতা করার লক্ষ্যে এক গ্রুপ থেকে তিনি অনার্থিক সহযোগিতা গ্রহণ করেছেন। যেমনঃ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যদ্রব্য, জীবানু নাশক, সুরক্ষা সামগ্রী ইত্যাদি। এই পন্যগুলো তিনি ঘটা করে ছবি তুলে, প্রচারণা চালিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের কাছে বিতরণ করেছেন। এরপর এ-সব পণ্য বিতরণের ছবি ও বিভিন্ন দালিলিক প্রমাণ নিয়ে তিনি গেছেন দ্বিতীয় গ্রুপের কাছে; যাদেরকে ফ্রিতে পাওয়া এই সব পণ্যসামগ্রী তার নিজের টাকায় কিনে বিতরণ করেছেন বুঝিয়ে, নিজের হাতে তৈরি করা ভুয়া ভাউচার জমা দিয়ে তাদের কাছ থেকে আদায় করেছেন লক্ষ লক্ষ টাকা। দেখুন, আমরা কত বড় স্বার্থপর হতে পারি। এটি তার প্রত্যক্ষ স্বার্থপরতা। কিন্তু এখানে আরেকটা দল আছে যারা ব্যাপারগুলো জানে কিন্তু কমিশনের কাছে নিজেকে বিক্রি করে। এরা পরোক্ষ স্বার্থপর।

স্বার্থপরতার উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। স্বার্থপরতা এড়িয়ে চলতে পারা এখন এক বড় সাধনা ব্যাপার।

Post Comment

No comments:

Post a Comment