Thursday, May 23, 2013

=চরিত্র - হনন=

২০১১ সালের কথা বলছি। আমি তখন চাকুরির সুবাদে চট্টলা'য়। থাকতাম ডেবার পাড়ের ঐতিহাসিক ৩২ নং বাসায়। মাঝে মাঝে মনে হত বাড়িওয়ালা চাচাকে শুধু শুধু ভাড়ার টাকাটা দেয়া কারন সকাল ৭ টায় বাসা হতে বেরিয়ে যেতাম ফিরতাম রাত প্রায় ৯ টায়। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টায় বাসায় থাকা হত মাত্র ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা।

অফিস শেষ হলে সন্ধায় সময় কাটাতাম কখনো জি ই সি মোড়, কখনো শিল্প কলা, কখনো- বা ডিসি হিল- এ। ভালই কাটছিল। এর মধ্যেই পরিচয় হল একজন চাকুরীজীবী-র সাথে, তিনিও ওই সব জাইগায় সন্ধ্যার সময় কাটাতেন। বড় ভাই এর নাম "সহান" ভাই। তিনি ছিলেন মিষ্ট ভাষী, সদালাপী, সুদর্শন চেহারা'র অধিকারি এবং বিবাহিত।

অল্প দিনেই সহান ভাই এর সাথে আমার বেশ জমে গেল। প্রায় প্রতিদিন সন্ধায় দু'জনের দেখা হত, অনেক বিষয় নিয়ে দু'জনে আড্ডা দিতাম, এবং যথারীতি অনেক রাতে বাসায় ফিরে যেতাম। আস্তে আস্তে বাক্তিগত বিষয়াদি-ও শেয়ার হতে লাগল। আলাপচারিতায় জানলাম, ভাবি ঢাকা য় থাকেন এবং একটি প্রাইভেট কোম্পানি তে জব করেন।

একদিন বিকেল বেলার ঘটনা বলছি। আমি তখনও অফিস-এ। সহান ভাই এর ফোন আসল। রিসিভ করলে তিনি আমাকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে ডিসি হিল যেতে বললেন, কারন জানতে চাইলে বললেন, "ব্যাপার আছে, ভাই জলদি আসেন"। আমি সাড়া দিলাম। তাড়াতাড়ি অফিস হতে বেরিয়ে রওনা দিলাম ডিসি হিল এর উদ্দেশে


ডিসি হিল পৌঁছে সহান ভাই কে পেলাম, ক্লিন সেভ করে রঙ্গিন টি শার্ট পড়ে একটি পাথরের বেঞ্চ এ বসে বিড়ি ফুকছেন। কাছে পৌছাতেই মুখে এক তোলা হাসি ছড়িয়ে সিগারেট অফার করলেন। কি ব্যাপার জানতে চাইলাম, জানালেন একজন আজ উনার সাথে ডিসি হিল এ দেখা করতে আসছেন। রহস্যের গন্ধ পেলাম। খুঁটাতে শুরু করলাম। সহান ভাই, বড় ভাই এর মত আমাকে বললেন- "আপনি কিছুই বলবেন না, শুধু দেখবেন"। আমি সম্মতি সুচক মাথা নাড়লাম আর অজানা "ব্যাপার" নিয়ে মনে মনে অনেক জল্পনা কল্পনা 'র জাল বুনতে লাগলাম।

কিছু সময় পর দেখলাম সহান ভাই'র মোবাইল এ রিং আসল, ভাই আমাকে বললেন, "চলে আসছে" , বলেই ছোট একটা লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে এদিক অদিক তাকাতে তাকাতে ফোন রিসিভ করলেন এবং ফোন কারি বাক্তির নিকট ডিসি হিল এ আমাদের অবস্থান, উনার পরনের টি শার্ট এর রং, পেন্ট এর ধরন ইত্যাদি বর্ণনা করে ফোন রাখলেন। আমিও সহান ভাই এর পাশে দাঁড়িয়ে অবস্থা বুঝার চেষ্টা করছিলাম এবং টের পাচ্ছিলাম কেন যেন আমার হৃদ যন্ত্র স্বাভাবিক এর চেয়ে একটু বেশি জোরে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

একটু পর সহান ভাই এর মোবাইল আবার বাজতেই আবিষ্কার করলাম আমাদের সামনে এক মা তার মেয়ে কে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মনে হল হাফ ছেড়ে বাচলাম এবং নিজেকে দোষ দিতে লাগলাম, সহান ভাই কে নিয়ে এতক্ষন কতই না বাজে চিন্তা করে ফেলেছি। ধরেই নিলাম ভাই এর সাথে দেখা করতে ভাবি এসেছেন। সালাম বিনিময় হল। এক সাথে চার'জন গোল করে বসে পড়লাম। সহান ভাই আমাকে আগন্তুক দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি সহাস্য বদনে জিজ্ঞাসা করলাম, "ভাবি ঢাকা হতে কখন আসছেন?" আমার প্রশ্ন শুনে ওই মা'র মুখ কেমন যেন বিবর্ণ হয়ে গেল, এই অবস্থা দেখে আমি হা করে ছিলাম, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। সহান ভাই নিরবতা ভাঙলেন, ব্যাপার টা আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, বললেন " ও জেসি, আমার ফ্রেন্ড"। ৫ ফুট ১ ইঞ্চি'র, ফর্সা বরনের, প্রায় ৯০ কেজি দেহ সম্মন্ন জেসি কে তখন আমার মন আর মা বলছিল না, বলছিল মহিলা। যা হোক, জেসি নামক মহিলা'র সাথে সহান ভাই সহ বসে অনেক ভিত্তিহীন কথা বার্তা হল, বন্ধুত্তের ঐতিহ্যবাহী ফুস্কা খাওয়া হল এবং প্রায় ২ ঘণ্টা আমাদের সাথে অতিবাহিত করে জেসি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। এর মাঝে আমি জেনে গেছি, জেসির সাথে আগত মেয়ে টি জেসির মেয়ে, নাম তাসফি, ২য় শ্রেনির ছাত্রি। জেসি'র স্বামী বিদেশ থাকেন, মুরাদপুরের কাছে স্বামী'র নিজ বাড়িতে জেসি তার এক মাত্র সম্বল মেয়ে তাসফি কে নিয়ে থাকেন, একা একা থাকতে থাকতে জেসি ক্লান্ত, ভাল একজন বন্ধু খুজছিলেন এবং মোবাইল এর রং নাম্বার এর কল্যাণে সহান ভাই এর সাথে জেসি'র পরিচয় ও আজকেই দু'জনের প্রথম আখি মিলন। ওই দিন আর অপেক্ষা করলাম না, বিদায় নিলাম।

এরপর সময় বয়ে যাচ্ছিল, আড্ডাও চলছিল নিয়মিত, আড্ডার ফাঁকে সহান ভাই জেসি'র ফোন রিসিভ করতেন, মাঝে মাঝে আমার সাথেও কথা বলিয়ে দিতেন, কথা বলতাম, জেসি'র কাছে সহান ভাই এর নামে মিথ্যা প্রসংশা করতাম, যা ছিল সহান ভাই এর ডিমান্ড। সহান ভাই আমাকে বুঝাতেন, মেয়ে টি খুব অসহায়, অনেক টাকার মালিক কিন্তু কথা বলার মত একজন সঙ্গি তার নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। সহান ভাই এর এই ধরনের সমাজ সেবা দেখে বন্ধু হিসেবে নিজেকে ধন্য মনে করতে লাগলাম! আসলেই তো! সহান ভাই যদি এই মহিলাটি'র জীবনে এই ভাবে না আসতেন, তাহলে কি যে সর্বনাশ হত!

বুঝতে পারছিলাম, সম্পর্ক (!!) ক্রমেই গভীর (!!) হচ্ছে তাদের।

কয়েকদিন পর, অফিস থেকে মাত্র বেরুচ্ছি, এই সময় মোবাইল এ সহান ভাই এর কল পেলাম। বললেন আপনি অফিস থেকে সোজা মুরাদপুর চলে আসেন আমি ওয়েট করছি। নতুন কোন ব্যাপার আবিস্কার এর কৌতূহলে আমিও আর দেরি করলাম না। মুরাদপুর পৌছলে সহান ভাই বললেন, "আজ, দাওাত আছে", "জেসি'র বাসায়"। আমার হৃদ যন্ত্র আবার কেমন যেন শক্তিশালি হয়ে উঠল, টের পেলাম।

কলিং বেল টিপ দিতে দরজা খুলে গেল। তখন প্রায় সন্ধ্যা ৬ টা। ৯০ কেজি দেহ নিয়ে চ্যাপ্টা মুখে হাসি ফুটিয়ে দরজা খুললেন "জেসি"। হাসি হাসি মুখ করে সহান ভাই এর পিছু পিছু ধুকে পড়লাম ড্রইং রুম এ। দারুন গুছনু রুম। দামি দামি জিনিস পত্র নজরে পড়ল। তাসফি এসে বসল আমাদের পাশে। আজাইরা গল্প শুরু হল। একটু পর বিশাল সমারোহে নাস্তার ট্রে নিয়ে হাজির হল জেসি। নাস্তা'র বাহার দেখে আমার জিব লক লক করে উঠল। মনে মনে বলতে লাগলাম, এই না হলে বিদেশি'ওয়ালার বাসা ? নাস্তা দেখেই খান্দান টের পাওয়া যায়!! অনুমতির জন্য একটু অপেক্ষা করেই আমি আপেল, কমলা, নাসপাতি, আঙ্গুর, হরলিক্স ইত্যাদি সাবাড় করার দিকে মন দিলাম। নাস্তা খেতে খেতে খেয়াল করলাম, মোটা মহিলা আজ অনেকটা কনের সাজে নিজেকে সাজিয়েছে। বিষয়টি লক্ষ্য করতে এক "সাক্ষী" হওয়ার ভয়ে আমার খাওয়ার গতি কমে যথারীতি হৃদ যন্ত্রের গতি বেড়ে গেল। গল্প চলছিল, খেয়াল করছিলাম, বাসায় আমরা চার'জন ছাড়া আর কেউ নেই, সহান ভাই ও জেসি মুখের পাশাপাশি চোখেও কথা বলতে পারেন(!), সহান ভাই তাসফি কে মেয়ে মেয়ে বলে ডাকছেন, অতি মাত্রায় আদর করছেন এবং আমাদের কথা বার্তা তে সহান ভাই এর স্ত্রী বা জেসির স্বামী কোন বিষয় উল্লেখিত হচ্ছে না।

রাত তখন ৮ টা। রাতের খাবার ওখানে খেয়ে যেতে হবে। জেসি'র আবদার কোন ভাবেই ফেলতে পারলেন না সহান ভাই, আর আমি পারলাম না সহান ভাই এর আবদার ফেলতে। ৮ টার সময় জেসি তাদের বাসার চরম সুন্দর ছাদ পরিদর্শন করতে আমদের আমন্ত্রন জানালেন। এবারও আবদার রক্ষা হল। চার'জন মিলে ছাদে গেলাম। আসলেই সুন্দর। জেসি'র বিদেশি স্বামী নিজের মনের মাধুরি দিয়ে ছাদটি সাজিয়েছেন। আবিস্কার করলাম, সিঁড়ি ঘর এর দু'পাশে ছাদটি দু'ভাগে বিভক্ত। এক পাস খোলা, অন্য পাশে ছোট করে একটি ঘর বানানু, উপরে টিন দিয়ে, ওই ছোট ঘরে শোয়ার জন্য পরিপাটি করে একটি বিছানাও পাতা আছে। ছাদের চার পাশে গাছ থাকায় আশে পাশের সকল ভবন হতে ছাদটি বিচ্ছিন্ন। যা হোক আমরা গোল হয়ে বসলাম ছাদের খোলা পাশে। আবার শুরু হল আজাইরা আলাপ, বিষয়- ছাদের সৌন্দর্য ও এ বিষয়ে জেসি'র অবদান।

সহান ভাই এর কিছুটা অস্বাভাবিক আচরন দেখে আধো আলোয় খেয়াল করলাম জেসি পাশে বসা সহান ভাই কে বার বার হাত দিয়ে আলতো করে ধাক্কা দিচ্ছে এবং চোখ নাড়িয়ে কি যেন বলছে। সহান ভাই হয়ত জেসি'র সেই আহ্বান এড়িয়ে যেতে চাচ্ছেন। এক পর্যায়ে জেসি মুখ ফুটে বলে উঠলেন, "দাদা, আপনি তাসফি র সাথে এখানে একটু বসেন, আমি আপনার সহান ভাইকে একটি জিনিস দেখিয়ে আনি"। বাধ্যগত ছাত্রের মত আমি হা সূচক মাথা নাড়লাম এবং তাসফি'র সাথে গল্প করতে শুরু করলাম। তাসফি'র সাথে কথা বলতে বলতে আমি আড় চোখে লক্ষ্য করলাম, তারা দু'জন ছাদের অন্য পাশের রুম এ গিয়ে ধুকেছেন। আধো আলোতে এবং রুম এর ভিতরে চলে যাওয়াতে ইচ্ছে থাকলেও কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। শুধু মাঝে মাঝে দুএকটি বিকৃত আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার আর কিছু বুঝতে বাকি থাকল না।

মিনিট ১৫ পরে হাসি মুখে কিছুটা হাপাতে হাপাতে দু'জন বেরিয়ে আসলেন। অনেকটা স্বাভাবিক আচরন করতে লাগলেন, যেন কিছুই হয় নি। আমিও চেষ্টা করছিলাম, যতটুকু স্বাভাবিক আচরন করা যায়। সবাই সব কিছু বুঝছি কিন্তু সবাই ভাব ধরে আছি। হয়ত তাসফি কিছু বুঝে নি।

বাসায় ফিরে শুলাম। অনেক চিন্তা আসতে থাকল মাথায়, আসতে থাকল অনেক প্রশ্ন- কিভাবে সম্ভব? দুজনই তো বিবাহিত, তাহলে? কয় দিনেরই -বা পরিচয় দু'জনের? সহান ভাই এর কি একবার -ও তার বিবাহিত বউ এর কথা মনে পড়ে নি? জেসি'র কি মনে পড়ে নি তার স্বামী'র কথা? সন্তান কে পাশে বসিয়ে কিভাবে জেসি এই কাজ করতে পারল? এই কি চরিত্রের মূল্য? এত সহজে চরিত্র হনন করা যায়?

বিঃ দ্রঃ এর পর থেকে সহান ভাই এর সাথে আমার শুধু হাই হ্যালো সম্পর্ক।

পুনশ্চ - বাস্তব কোন ঘটনা নয়।

Post Comment

No comments:

Post a Comment