২১/৩/১৩
রোজ বৃহস্পতি বার, ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৭ টা বেজে ২০ মিনিট। আমি সবে শরীর
চর্চা শেষ করে স্নান করার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় বস এর ফোন আসল। রিসিভ
করতে বস বললেন, রেডি হয়ে নেন, "মুণ্ডুমালা" যেতে হবে। জায়গার নাম শুনে
একটু ঘাবড়ে গেলাম। বস বিষয় টা পরিষ্কার করলেন, "রাজশাহী" জেলার "তানোর"
উপজেলার একটি ইউনিয়ন এর নাম "মুণ্ডুমালা"। অফিসিয়াল কাজে বস ওখানে যাবেন, যেহেতু অনেক দুরের পথ তাই আমাকে সাথি করবেন।
বস আসলেন এবং আমার প্রিয় পথের সাথি "CRUX" এ চাপলাম। "মান্দা ফেরী ঘাট" হয়ে "দেলাবাড়ি" র পার হয়ে ছুটে চললাম। যেতে যেতে আলাপ চারিতায় বস এর কাছ থেকে জানতে পারলাম, আমরা "মুণ্ডুমালা" ইউনিয়ন এর "দুবইল" গ্রামে যাচ্ছি বিলুপ্ত ধানের রক্ষক "ইউসুফ মোল্লা" -র সাথে দেখা করতে। গত ১৬ মার্চ "দৈনিক প্রথম আলো" তাঁকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে। পেপার টা বস এর কাছেই ছিল, চলন্ত অবস্থায় এক পলক চোখ বুলিয়ে নিলাম ঐ পেপার এ।
ততক্ষনে আমরা "চোবারিয়া" পৌঁছে গেছি। একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে বাম দিকে মোড় নিলাম, এগিয়ে চললাম "তানোর" অভিমুখে। রাস্তা খুব ভাল, তাই ভাল লাগছিল, আরও বেশি ভাল লাগছিল রাস্তার দু'পাশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে, মনে হচ্ছিল প্রকৃতির বুকের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলেছি। একটু পর আমার বস আমাকে রাস্তার ঠিক পাশের আলু ক্ষেতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করালেন। বাংলা মায়ের জমির উর্বরতা দেখে সত্যি মুগ্ধ হলাম। এত বেশি আলুর ফলন হয়েছে যে, মাটির নিচে জায়গা না পেয়ে প্রতি আলে বেশ কিছু করে আলু মাটির উপর উঠে আছে। আর একটু এগুবার পর দেখলাম রাস্তার উপর ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, পাইকার রা এসে জমি থেকেই আলু কিনে ট্রাকে তুলছেন। একটু খবর নিয়ে জানলাম, প্রতি কেজি আলু এ অঞ্চলে এখন বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকা দরে। এ অঞ্চলে এত বেশি আলুর ফলন চোখে পরেছে যে ভেবে নিতে বাধ্য হলাম, এখানে একটি আলু থেকে উৎপাদিত পণ্যের কারখানা খুব সহজেই করা যায়।
যা হোক ইতিমধ্যে আমরা "তালন্দ" পেরিয়ে এসেছি। একটু খবর নিয়ে প্রধান সড়ক হতে আমার একটি গ্রাম্য পাকা রাস্তায় নামলাম এবং চলতে থাকলাম। রাস্তার দু'পাশে সারি সারি আম এর গাছ গুলু সড়কের সোনদরজ বহু গুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। সর্পিল রাস্তা। দু'পাশের জমি গুলুর দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বুজতে পারছিলাম, এখন আমি "বরেন্দ্র অঞ্চল" এ।
অবশেষে প্রায় ১০০ কি মি পথ শেষ হল, পোঁছালাম লক্ষিত "দুবইল" গ্রামে। মোড়ে দাঁড়িয়ে "ইউসুফ মোল্লা" র কথা জিজ্জাসা করতেই দু তিন জন এগিয়ে এলেন, বুঝলাম এলাকায় "মোল্লা সাহেব" একজন পরিচিত মুখ। এগিয়ে আসা লোক দের মধ্যে একজন "ইউসুফ মোল্লা" র ভাই। জানালেন "মোল্লা সাহেব" "মুণ্ডুমালা" গেছেন ডাক্তার এর কাছে, কারন তিনি হাতের আঙ্গুলে গরু বাঁধতে গিয়ে আঘাত পেয়েছেন। নাম্বার নিয়ে ফোন করা হল এবং এগিয়ে চললাম "মুণ্ডুমালা"র দিকে।
"মুণ্ডুমালা" গিয়ে দেখা হল "ইউসুফ মোল্লা" র সাথে। লুঙ্গি, শার্ট পরা মুখ ভর্তি দাঁড়ি সমৃদ্ধ একজন সাদা মাটা লোক। মুখে এক খণ্ড হাসি যেন তাঁর সাইনবোর্ড। ভাল লাগল। পরিচয় দিয়ে আলাপ শুরু হল। ডাক্তার আসতে বেশ কিছু সময় বাকি আছে জেনে আমরা প্রস্তাব দিলাম, এর মধ্যে আমরা তাঁর সংগ্রহ শালা একটু দেখতে চাই। রাজি হলেন এবং তাঁকে সাথে নিয়ে আবার রওনা দিলাম "দুবইল" এর পথে, বেশি পথ নয়, ৪/৫ কিলো হতে পারে। যা হোক, চলতি পথে বস এর সাথে "মোল্লা সাহেব" এর আলাপ চলতে থাকল। কি করে তিনি এ'কাজ শুরু করলেন, কি ভাবে করেন, কয় প্রজাতির ধান তাঁর সংগ্রহে আছে, কিভাবে সংগ্রহ করেন, কারা তাঁকে সহযোগিতা করেন, এই পর্যন্ত কাজের কি কি স্বীকৃতি পেয়েছেন ইত্যাদি। লক্ষ্য করলাম, তিনি ঐ প্রশ্ন গুলুর যে উত্তর দিচ্ছিলেন তা "দৈনিক প্রথম আলো" পেপারে প্রকাশিত প্রতিবেদবন এর অনুলিপি, যা ইতিমধ্যে আমি পড়ে ফেলেছি, তাই উনার কথা শুনার চেয়ে প্রকৃতি দেখার দিকেই বেশি মনোযোগ দিলাম। কিন্তু একটু পর আমার বসের "আপনার পরিবারের কে কে এই কাজে আপনাকে সহযোগিতা করেন" প্রশ্নের তিনি যে উত্তর দিলেন তাতে আবার তাঁর দিকে মনোযোগ দিলাম। কারন আমাকে অবাক করে তিনি উত্তর দিলেন যে তাঁর পরিবারের কেউ তাঁকে এই কাজে সহযোগিতা করেন না, তাঁর স্ত্রী, ছেলে কেউ না, এমনকি তিনি আরও জানালেন যে তিনি যে কাজ গুলু করেন তাঁর পরিবারের কাছে তাঁর কোন গুরুত্ব নেই, তারা "মোল্লা সাহেব" এর কাজকে আ-কাজ বলে বিবেচনা করেন। তখন আমার বস তাঁকে প্রশ্ন করলেন, এই যে এত বড় একটি পেপার এ আপনাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হল, এরপরও কি আপনার পরিবারের লোকজন এর চিন্তাধারা বদলায়নি? তিনি উত্তরে জানালেন, না। বিশেষ করে তাঁর স্ত্রী এবং বড় ছেলে তাঁর ছায়াও মাড়াতে চান না। অবশ্য তিনি আরও জানালেন, তাঁর একজন ছোট ভাই আছেন, যিনি তাঁকে মাঝে মাঝে এই কাজে সহযোগিতা করেন। অবাক হয়ে গেলাম আর মনে মনে ভাবলাম, এই পরিবারে আর কোন গুণী জন্মাবে না, কারন এই পরিবারটি গুণীর কদর করতে জানে না।
যা হোক পৌঁছে গেলাম, "ইউসুফ মোল্লা" র সংগ্রহ শালায়। পথের ধারে ইটের দেয়ালের টিনের ছাউনি বিশিষ্ট একটি ঘরকে বানিয়েছেন তিনি তাঁর সংগ্রহ শালা। "রাঁধুনিপাগল, ঝিঙ্গাশাইল, দুধসর, জামাই সোহাগী, নারী পারিজাত, পিঁপড়ার চোখ, সোনামুখী, সোনাকাঠি, সাদাবোরা, কালাবোরা, মধু মাধব, দাদ খানি, হিদা, দিঘা, ভোজনা, কাকুরি, সাথিয়া" সহ প্রায় ৪০ ধরনের বিলুপ্ত ধান দেখালেন আমাদের। তাঁর সংগ্রহ শালায় শুধু যে তিনি ধান সংগ্রহ করেন, তা নয়, প্রায় ২০০ ঐতিহাসিক বই সংগ্রহে আছে তাঁর, আছে পুরনো আমলে বাসন কোসন, অলংকার ইত্যাদি। শহর থেকে দূরে এক নিভৃত পল্লীর বাসিন্দা "ইউসুফ মোল্লা" র সংগ্রহের ভাণ্ডার দেখে আসলেই অভিভূত হতে হয়। ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় দুপুর ১ টা। উঠার চিন্তা করছি। মোল্লা সাহেব বললেন, আপনারা যদি একটু অপেক্ষা করতে পারেন তাহলে আমি ডাক্তার দেখিয়ে আপনাদের সাথে "মহাদেবপুর" যাব। ওখানে আমার কাজ আছে। রাজি হলাম।
২ টার দিকে তিনি প্রস্তুতি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলেন। তাঁকে নিয়ে ফিরতি পথে চলতে শুরু করলাম। একটু পর তিনি বললেন "তালন্দ" গিয়ে ভাত খাব"। আগ্রহ নিয়ে বস জানতে চাইলেন, "কেন আপনি বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে বের হননি?" "মোল্লা সাহেব" জানালেন, না। কেন - জানতে চাইলে উত্তর দিলেন, বাড়িতে বড় ছেলে আছে, তাই যেহেতু আপনাদের খাওয়াতে পারব না, তাই আমিও না খেয়ে বেরিয়ে গেছি। তাঁর উত্তর শুনে আমার মনটা উদাস হয়ে গেল, মনে মনে ভাবতে লাগলাম, কেন এমন হয়?
"তালন্দ" পৌঁছে সবাই মিলে ভাত খেলাম। আবার রওনা দিলাম। "ইউসুফ মোল্লা" একটা পালা গান ধরলেন।
৭০/৮০ কি মি পার ঘণ্টা গতিতে প্রকৃতির বুকের মাঝখান দিয়ে আমাকে, আমার বসকে এবং লুপ্ত ধানের রক্ষক "ইউসুফ মোল্লা" কে পিঠে চাপিয়ে আমার প্রিয় CRUX নওগাঁ অভিমুখে ছুটে চলল।
পুনশ্চঃ ২০১৩ সালের ৬ জুন ঢাকায় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে জাতীয় পরিবেশ পদক গ্রহণ করবেন ইউসুফ মোল্লা। ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারী সর্বশেষ 'কালের কন্ঠে' মোল্লা সাহেবকে নিয়ে করা একটি প্রতিবেদন চোখে পড়ে।
------------------------------ ------------------------------ ------------------------------ ---------
"দৈনিক প্রথম আলো" তে প্রকাশিত প্রতিবেদন এর লিংক- (২০ নং পাতা, নিচের দিকে / শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন)
প্রথম আলো লিংক / এখানে ক্লিক করুন
বস আসলেন এবং আমার প্রিয় পথের সাথি "CRUX" এ চাপলাম। "মান্দা ফেরী ঘাট" হয়ে "দেলাবাড়ি" র পার হয়ে ছুটে চললাম। যেতে যেতে আলাপ চারিতায় বস এর কাছ থেকে জানতে পারলাম, আমরা "মুণ্ডুমালা" ইউনিয়ন এর "দুবইল" গ্রামে যাচ্ছি বিলুপ্ত ধানের রক্ষক "ইউসুফ মোল্লা" -র সাথে দেখা করতে। গত ১৬ মার্চ "দৈনিক প্রথম আলো" তাঁকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন করেছে। পেপার টা বস এর কাছেই ছিল, চলন্ত অবস্থায় এক পলক চোখ বুলিয়ে নিলাম ঐ পেপার এ।
ততক্ষনে আমরা "চোবারিয়া" পৌঁছে গেছি। একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে বাম দিকে মোড় নিলাম, এগিয়ে চললাম "তানোর" অভিমুখে। রাস্তা খুব ভাল, তাই ভাল লাগছিল, আরও বেশি ভাল লাগছিল রাস্তার দু'পাশের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে, মনে হচ্ছিল প্রকৃতির বুকের মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলেছি। একটু পর আমার বস আমাকে রাস্তার ঠিক পাশের আলু ক্ষেতের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করালেন। বাংলা মায়ের জমির উর্বরতা দেখে সত্যি মুগ্ধ হলাম। এত বেশি আলুর ফলন হয়েছে যে, মাটির নিচে জায়গা না পেয়ে প্রতি আলে বেশ কিছু করে আলু মাটির উপর উঠে আছে। আর একটু এগুবার পর দেখলাম রাস্তার উপর ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে, পাইকার রা এসে জমি থেকেই আলু কিনে ট্রাকে তুলছেন। একটু খবর নিয়ে জানলাম, প্রতি কেজি আলু এ অঞ্চলে এখন বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকা দরে। এ অঞ্চলে এত বেশি আলুর ফলন চোখে পরেছে যে ভেবে নিতে বাধ্য হলাম, এখানে একটি আলু থেকে উৎপাদিত পণ্যের কারখানা খুব সহজেই করা যায়।
যা হোক ইতিমধ্যে আমরা "তালন্দ" পেরিয়ে এসেছি। একটু খবর নিয়ে প্রধান সড়ক হতে আমার একটি গ্রাম্য পাকা রাস্তায় নামলাম এবং চলতে থাকলাম। রাস্তার দু'পাশে সারি সারি আম এর গাছ গুলু সড়কের সোনদরজ বহু গুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। সর্পিল রাস্তা। দু'পাশের জমি গুলুর দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট বুজতে পারছিলাম, এখন আমি "বরেন্দ্র অঞ্চল" এ।
অবশেষে প্রায় ১০০ কি মি পথ শেষ হল, পোঁছালাম লক্ষিত "দুবইল" গ্রামে। মোড়ে দাঁড়িয়ে "ইউসুফ মোল্লা" র কথা জিজ্জাসা করতেই দু তিন জন এগিয়ে এলেন, বুঝলাম এলাকায় "মোল্লা সাহেব" একজন পরিচিত মুখ। এগিয়ে আসা লোক দের মধ্যে একজন "ইউসুফ মোল্লা" র ভাই। জানালেন "মোল্লা সাহেব" "মুণ্ডুমালা" গেছেন ডাক্তার এর কাছে, কারন তিনি হাতের আঙ্গুলে গরু বাঁধতে গিয়ে আঘাত পেয়েছেন। নাম্বার নিয়ে ফোন করা হল এবং এগিয়ে চললাম "মুণ্ডুমালা"র দিকে।
"মুণ্ডুমালা" গিয়ে দেখা হল "ইউসুফ মোল্লা" র সাথে। লুঙ্গি, শার্ট পরা মুখ ভর্তি দাঁড়ি সমৃদ্ধ একজন সাদা মাটা লোক। মুখে এক খণ্ড হাসি যেন তাঁর সাইনবোর্ড। ভাল লাগল। পরিচয় দিয়ে আলাপ শুরু হল। ডাক্তার আসতে বেশ কিছু সময় বাকি আছে জেনে আমরা প্রস্তাব দিলাম, এর মধ্যে আমরা তাঁর সংগ্রহ শালা একটু দেখতে চাই। রাজি হলেন এবং তাঁকে সাথে নিয়ে আবার রওনা দিলাম "দুবইল" এর পথে, বেশি পথ নয়, ৪/৫ কিলো হতে পারে। যা হোক, চলতি পথে বস এর সাথে "মোল্লা সাহেব" এর আলাপ চলতে থাকল। কি করে তিনি এ'কাজ শুরু করলেন, কি ভাবে করেন, কয় প্রজাতির ধান তাঁর সংগ্রহে আছে, কিভাবে সংগ্রহ করেন, কারা তাঁকে সহযোগিতা করেন, এই পর্যন্ত কাজের কি কি স্বীকৃতি পেয়েছেন ইত্যাদি। লক্ষ্য করলাম, তিনি ঐ প্রশ্ন গুলুর যে উত্তর দিচ্ছিলেন তা "দৈনিক প্রথম আলো" পেপারে প্রকাশিত প্রতিবেদবন এর অনুলিপি, যা ইতিমধ্যে আমি পড়ে ফেলেছি, তাই উনার কথা শুনার চেয়ে প্রকৃতি দেখার দিকেই বেশি মনোযোগ দিলাম। কিন্তু একটু পর আমার বসের "আপনার পরিবারের কে কে এই কাজে আপনাকে সহযোগিতা করেন" প্রশ্নের তিনি যে উত্তর দিলেন তাতে আবার তাঁর দিকে মনোযোগ দিলাম। কারন আমাকে অবাক করে তিনি উত্তর দিলেন যে তাঁর পরিবারের কেউ তাঁকে এই কাজে সহযোগিতা করেন না, তাঁর স্ত্রী, ছেলে কেউ না, এমনকি তিনি আরও জানালেন যে তিনি যে কাজ গুলু করেন তাঁর পরিবারের কাছে তাঁর কোন গুরুত্ব নেই, তারা "মোল্লা সাহেব" এর কাজকে আ-কাজ বলে বিবেচনা করেন। তখন আমার বস তাঁকে প্রশ্ন করলেন, এই যে এত বড় একটি পেপার এ আপনাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হল, এরপরও কি আপনার পরিবারের লোকজন এর চিন্তাধারা বদলায়নি? তিনি উত্তরে জানালেন, না। বিশেষ করে তাঁর স্ত্রী এবং বড় ছেলে তাঁর ছায়াও মাড়াতে চান না। অবশ্য তিনি আরও জানালেন, তাঁর একজন ছোট ভাই আছেন, যিনি তাঁকে মাঝে মাঝে এই কাজে সহযোগিতা করেন। অবাক হয়ে গেলাম আর মনে মনে ভাবলাম, এই পরিবারে আর কোন গুণী জন্মাবে না, কারন এই পরিবারটি গুণীর কদর করতে জানে না।
যা হোক পৌঁছে গেলাম, "ইউসুফ মোল্লা" র সংগ্রহ শালায়। পথের ধারে ইটের দেয়ালের টিনের ছাউনি বিশিষ্ট একটি ঘরকে বানিয়েছেন তিনি তাঁর সংগ্রহ শালা। "রাঁধুনিপাগল, ঝিঙ্গাশাইল, দুধসর, জামাই সোহাগী, নারী পারিজাত, পিঁপড়ার চোখ, সোনামুখী, সোনাকাঠি, সাদাবোরা, কালাবোরা, মধু মাধব, দাদ খানি, হিদা, দিঘা, ভোজনা, কাকুরি, সাথিয়া" সহ প্রায় ৪০ ধরনের বিলুপ্ত ধান দেখালেন আমাদের। তাঁর সংগ্রহ শালায় শুধু যে তিনি ধান সংগ্রহ করেন, তা নয়, প্রায় ২০০ ঐতিহাসিক বই সংগ্রহে আছে তাঁর, আছে পুরনো আমলে বাসন কোসন, অলংকার ইত্যাদি। শহর থেকে দূরে এক নিভৃত পল্লীর বাসিন্দা "ইউসুফ মোল্লা" র সংগ্রহের ভাণ্ডার দেখে আসলেই অভিভূত হতে হয়। ঘড়ির কাঁটায় তখন প্রায় দুপুর ১ টা। উঠার চিন্তা করছি। মোল্লা সাহেব বললেন, আপনারা যদি একটু অপেক্ষা করতে পারেন তাহলে আমি ডাক্তার দেখিয়ে আপনাদের সাথে "মহাদেবপুর" যাব। ওখানে আমার কাজ আছে। রাজি হলাম।
২ টার দিকে তিনি প্রস্তুতি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলেন। তাঁকে নিয়ে ফিরতি পথে চলতে শুরু করলাম। একটু পর তিনি বললেন "তালন্দ" গিয়ে ভাত খাব"। আগ্রহ নিয়ে বস জানতে চাইলেন, "কেন আপনি বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে বের হননি?" "মোল্লা সাহেব" জানালেন, না। কেন - জানতে চাইলে উত্তর দিলেন, বাড়িতে বড় ছেলে আছে, তাই যেহেতু আপনাদের খাওয়াতে পারব না, তাই আমিও না খেয়ে বেরিয়ে গেছি। তাঁর উত্তর শুনে আমার মনটা উদাস হয়ে গেল, মনে মনে ভাবতে লাগলাম, কেন এমন হয়?
"তালন্দ" পৌঁছে সবাই মিলে ভাত খেলাম। আবার রওনা দিলাম। "ইউসুফ মোল্লা" একটা পালা গান ধরলেন।
৭০/৮০ কি মি পার ঘণ্টা গতিতে প্রকৃতির বুকের মাঝখান দিয়ে আমাকে, আমার বসকে এবং লুপ্ত ধানের রক্ষক "ইউসুফ মোল্লা" কে পিঠে চাপিয়ে আমার প্রিয় CRUX নওগাঁ অভিমুখে ছুটে চলল।
পুনশ্চঃ ২০১৩ সালের ৬ জুন ঢাকায় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে জাতীয় পরিবেশ পদক গ্রহণ করবেন ইউসুফ মোল্লা। ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারী সর্বশেষ 'কালের কন্ঠে' মোল্লা সাহেবকে নিয়ে করা একটি প্রতিবেদন চোখে পড়ে।
------------------------------
"দৈনিক প্রথম আলো" তে প্রকাশিত প্রতিবেদন এর লিংক- (২০ নং পাতা, নিচের দিকে / শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন)
প্রথম আলো লিংক / এখানে ক্লিক করুন
No comments:
Post a Comment