Thursday, January 7, 2021

অতৃপ্ত বাসনা

 অতৃপ্ত বাসনা


ছেলের নাম আবদুর রহমান। সবাই রহমান নামেই ডাকে। কিন্তু মা হোসনেয়ারা বেগম কখনো তাকে রহমান নামে ডাকেন না, তিনি সবসময় ছেলেকে আবদুর রহমান নামেই ডাকেন। এক কন্যা সন্তানের পর হোসেন চৌধুরী ও হোসনেয়ারা বেগমের কোল জুড়ে আসে আবদুর রহমান। হোসনেয়ারা বেগম বেশি ভালোবাসেন ছেলেকে। ছোটবেলা থেকে এক পলকের জন্য ছেলেকে চোখের আড়াল করতে তিনি নারাজ। 


আবদুর রহমানের বয়স এখন চার বছর। বর্তমানে তারা তিন ভাই, তিন বোন। সংসারে বেশ কয়েকজন নতুন অতিথির আগমন স্বত্তেও রহমান এখনো তার মায়ের কাছে সেই আদরের আবদুর রহমান। মা স্বভাবতই সকল সন্তানের প্রতি তাঁর স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা সমানভাবে বিলিয়ে দিয়েছেন কিন্তু আবদুর রহমানের স্থানটি অন্য কোন ভাই বোন দখল করতে পারেনি। রহমান তার মায়ের কাছে কাছেই থাকে। মায়ের কোলে মাথা রেখে প্রতিদিনই মায়ের অকৃত্রিম স্নেহ-ভালোবাসায় ধন্য হয় সে। অন্যান্য ভাইবোনরা মাঝেমধ্যে মায়ের বকুনি খেলেও হোসনেয়ারা বেগম কখনো আবদুর রহমানের প্রতি কঠোর হতে পারেন না। এক শীতল, স্বর্গীয়, গভীর অনুভূতি নিয়ে তিনি তাকান রহমানের দিকে৷ 


হোসেন চৌধুরী সাহেব বংশধর মানুষ। গঞ্জে বড় ব্যবসা সাথে ক্ষেতখামার। হোসেন সাহেবের দুটো শখ; টাকা উপার্জন ও নিজের বংশবৃদ্ধি। প্রতি বছর ব্যবসায় বড় অংকের লাভের পাশাপাশি একটা করে নতুন সন্তানের মুখ না দেখলেই নয়। বংশরক্ষাই বিয়ের একমাত্র উদ্দেশ্য বলে হোসেন সাহেবের দৃঢ় বিশ্বাস। বিয়ের ছয় বছরের মাথায় ব্যবসার লাভের টাকায় তিন কানি সম্পদ কিনার পাশাপাশি হোসনেয়ারা'র কোলে ছয়টি ফুটফুটে সন্তান তুলে দিতে পেরে হোসেন সাহেব অত্যন্ত গর্বিত। অন্যদিকে চৌদ্দ বছর বয়সে হোসেন সাহেবের বউ হয়ে এ বাড়িতে আসা হোসনেয়ারা বেগম প্রতি বছর বছর স্বামীর মুখে হাসি ফোটাতে ফোটাতে আজও ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসার বৃথা চেষ্টা করেন। কুড়ি বছর বয়সী হোসনেয়ারা বেগমকে ইদানীং চল্লিশোর্ধ্বই মনে হয়। তবে তিনি মন খারাপ করেন না। চৌধুরী বাড়িতে বিয়ে হয়েছে এটাই তো তাঁর সাত কপালের ভাগ্য! যখন খুব বেশি মন খারাপ হয় আবদুর রহমানকে কোলে নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি গুনগুন করে গান করেন। মন ভালো হয়ে যায়।


বছরখানেক পরের কথা। একদিন ভোরবেলা প্রচন্ড শোরগোলের মধ্যে আবদুর রহমানের ঘুম ভাঙে। বাড়িতে অনেক মানুষের সমাগম দেখতে পেয়ে চোখ ডলতে ডলতে রহমান ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উঠোনে একটা পাটিতে তার মাকে শুয়ে থাকতে দেখে। পরিবারের সদস্য ও নিকট আত্মীয়রা রহমানের মাকে ঘিরে বিলাপ করছেন। হোসেন সাহেব একপাশে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছছেন। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ মায়ের বুকে মাথা গুঁজে মাকে জড়িয়ে ধরে থাকা রহমানের দীর্ঘদিনের অভ্যাস, মাও তাকে পরম মমতায় দু'হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে চুমু খান। মায়ের আদরের আবদুর রহমান কারো দিকে তেমন লক্ষ্য না করে উঠোনে পাতা পাটিতে শুয়ে থাকা মায়ের বুকে মাথা গুঁজে দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। চারদিকের বিলাপের ধ্বনি উচ্চ হলো। হোসেন সাহেব সশব্দে হাউমাউ করে উঠলেন। কিন্তু আজ আর মমতাময়ী মা চোখ খুললেন না, দু'হাতে জড়িয়ে ধরলেন না তাঁর প্রিয় সন্তান আবদুর রহমানকে।


আবদুর রহমান কি কখনো জানবে তার বাবার বংশের সপ্তম প্রদীপ জ্বালতে গিয়ে মাত্র একুশ বছর বয়সে নিজেই চিরতরে নিভে গেলেন তার মমতাময়ী মা?

Post Comment

No comments:

Post a Comment