Thursday, January 7, 2021

যন্ত্র-মানব

 'যন্ত্র-মানব' এর পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব, যা মানুষের পক্ষে করা সম্ভব নয়। সময়ের প্রয়োজনে মানুষ এখন যান্ত্রিক হচ্ছে, জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে মানুষের চিন্তা চেতনা। এ পরিবর্তন রোধ করা আপাতদৃষ্টিতে সম্ভব নয়। তবে প্রকৃতি চাইলে তার আপন ক্ষমতাবলে শুধুমাত্র মানুষ নয় সমগ্র সৃষ্টিকে তার নিজের মতো করে পুনরায় সাজিয়ে তুলতে পারে। সেটা ভিন্ন ব্যাপার। কিন্তু মানুষ সহজাত ভাবেই কখনো পিছনে ফিরে যেতে চায় না। বিরতিহীন এগিয়ে যাওয়াই মানব সন্তানের ধর্ম। এই এগিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় প্রতিটি ধাপে প্রতিনিয়ত ঘটছে পরিবর্তন। 


যান্ত্রিক হওয়া বলতে শুধুমাত্র যন্ত্র নির্ভর হওয়াকেই বোঝানো হয় না। প্রকৃতির কোমল স্পর্শ এড়িয়ে যন্ত্র নির্ভর হওয়ার পাশাপাশি মানবিকতা হারানোকে এক কথায় যান্ত্রিকতা বলা যেতে পারে। ক্রমাগত পরিবর্তনের ধারায় মানুষ যন্ত্র নির্ভর হতেই পারে কিন্তু তার সাথে মানবিকতা কেন হারাবে? উত্তরটা এমন হতে পারে, আদিমকাল থেকেই প্রাকৃতিকভাবে মানুষের মাঝে দুটো বোধ কাজ করে বলে ধারণা করা হয়- ভালো বোধ ও খারাপ বোধ। ভালো বোধের চেয়ে খারাপ বোধই মানুষের মাঝে বেশি সক্রিয় থাকে। পরিবর্তনের সাথে সাথে এ দুটি বোধও পরিবর্তিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই 'দূর্বল' ভালো বোধ বেড়েছে গানিতিক হারে অন্যদিকে 'শক্তিশালী' খারাপ বোধ বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। ফলাফলে খারাপ বোধের চাপায় অতল গহবরে হাবুডুবু খাচ্ছে ভালো বোধ। ফলে মানুষ হারিয়েছে তার মানবিকতা। 


বাংলাদেশের 'এনটিভি' টিভি চ্যানেলের সূচনা লগ্নে উক্ত চ্যানেলের মূল স্লোগান প্রনয়ণের দায়িত্ব পড়ে প্রখ্যাত টিভি উপস্থাপক জনাব হানিফ সংকেত এর উপর। এনটিভি'র "সময়ের সাথে আগামীর পথে" স্লোগানটি প্রনয়ণ করে হানিফ সংকেত বলেছিলেন, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে না পারাটা আমাদের ব্যার্থতা। অর্থাৎ সময়ের সাথে আমাদের পরিবর্তিত হতেই হবে। আমরাও তাই হচ্ছি। তাহলে গোলটা কোথায়? অবশ্যম্ভাবী এই পরিবর্তনের ধারায় এগিয়ে যেতে যেতে মানবিকতা হারা কেন হচ্ছি আমরা? কেন ভালো বোধগুলো আমাদের খারাপ বোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? পরিবর্তনকে আমরা অস্বীকার করতে পারবো না, সাথে সাথে অমানবিক হওয়াও কি আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক? 


আমরা কথায় কথায়ই বলি, হাতি নিজের শরীর দেখে না। হাতিদের হাসি আমরা বুঝি না। তা নাহলে আমাদের এমন কথা শুনে তাদের অট্ট হাসিতে হয়তো আমরা লজ্জিত হতাম। আসলে মানুষই তার নিজের শরীর দেখে না অর্থাৎ নিজের কপটতা, নিজের চরিত্রহীনতা, নিজের দূর্বলতা- এসব মানুষের নজড় এড়িয়ে যায়। তারা সবসময় অন্যের অনুশীলনে তৃপ্তি বোধ করে, অন্যের সমালোচনায় মনে পাশবিক আনন্দ অনুভব করে, অন্যের ত্রুটি অন্বেষণে সবসময় সচেষ্ট থাকে। এতো কিছুর মাঝে নিজের দিকে নজড় দেওয়ার সময় কোথায়! এর ফলে সে নিজের বিবেক'কে জাগ্রত করতে পারে না। বিবেক মানুষের মনের এন্টিবডি, যা খারাপ বোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এতে করে অমানবিক হওয়ার পথে আর কোন বাধাই থাকে না।


রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, দূরে থাকার আনন্দই হলো চিঠি। আজকের দিনে চিঠির জায়গা দখল করেছে এসএমএস, ই-মেইল ইত্যাদি। এতে দোষের কি আছে? কবি গুরুর জীবদ্দশায় এসব আবিষ্কার হলে তিনিও নিশ্চয়ই এ পরিবর্তন মেনে নিতে দ্বিধা করতেন না। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বস্তুগত যন্ত্রের উপর নির্ভরশীলতা স্বাভাবিক। কিন্তু মানসিক যান্ত্রিকতা কি গ্রহণযোগ্য?

Post Comment

No comments:

Post a Comment