Thursday, April 30, 2020

দাঁত-কথা


আমার এক কাজিন জেনারেল ফিজিশিয়ান। তার সাথে আবার আমার খুব ভাব। দুজনে বন্ধুর মতো নিজেদের সুখ-দুঃখ শেয়ার করি। তার নাম আকাশ। অত্র এলাকায় মেডিকেল লাইনে তার বেশ জানাশোনা। একদিন নাস্তা শেষ করে দুই ভাই স্কুলের মাঠে বসে সুখ-দুঃখের কথা বলছিলাম। আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি হোটেলের ম্যানেজার থেকে চেয়ে এনেছিলাম। কথার ফাঁকে ফাঁকে ওই দেশলাইকাঠি দিয়ে আমার দন্ত গর্ভ খালি করছিলাম।

আমাদের মুখের ভেতর দুই ধরণের দাঁত থাকে। কিছু দাঁত সিঙ্গেল পার্টের আবার কিছু ডবল পার্টের। সিঙ্গেল পার্টের দাঁতগুলো মুখগহ্বরের সামনের অংশে অবস্থান করে আমাদের শ্রীবৃদ্ধি করে আর দাঁত নামক অঙ্গের মূল কাজসমূহ সাধিত হয় মুখের ভিতরের দিকে অবস্থানকারী ডবল পার্টের দাঁতগুলোর দ্বারা। তবে দর্শনধারী ও গুনবাহী উভয় ধরণের দাঁতই আমাদের প্রয়োজন। আজ আমি যে দাঁতের কথা বলছি, তা একটি ডবল পার্টের দাঁত; ডানপাশের নিচের সারিতে যার অবস্থান। অন্যান্য সাধারণ  দাঁতের চেয়ে এই দাঁতের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশ পেতে থাকে বছর দশেক আগে, যখন এই ডবল পার্টের দাঁতের ঠিক মাঝখানে একটা গর্ত আস্তে আস্তে তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল। গর্তটা বড় হচ্ছিল এবং বছর দুয়েকের মধ্যে বেশ ভালো বিস্তৃতি লাভ করেছিল। খাওয়া শেষে উক্ত গর্ত গর্ভ খালি করতে একটি দেশলাইয়ের কাঠি বিনা বাধায় ওই গর্তে প্রবেশ করতে পারতো।

রহমান ভাই খুব আন্তরিক মানুষ। যত্নসহকারে উপর-নিচ উভয় পাটির দাঁত পরীক্ষা করে রায় দিলেন যে, আমার দাঁত ব্যাটারা এখনো অনেক ভালো ও শক্তপোক্ত আছে। মাঝেমধ্যে সিনসিন বা হালকা ব্যাথা হয়তো করে তবে এটা এমন বড় কিছু না। আর উনি বেশি পাওয়ারের একটা সাদা লাইট আমার মুখের ভিতরে জ্বালিয়ে দিয়েও দাঁতে কোন গর্ত আবিষ্কার করতে পারলেন না। আমাকে বুঝিয়ে বললেন, "এটা আপনার প্রি মাইন্ড সেটআপ। আপনার কাছে মনে হয় একটা গর্ত আছে, আসলে নাই। আমাদের ডাক্তারদের কাজই হলো আপনাদের এই সব অহেতুক দুশ্চিন্তা দূর করে আপনাদের সুস্থ জীবনযাপন নিশ্চিত করা। তারপরও মনে অশান্তি থাকলে আগামী শুক্রবার চলে আসবেন, প্রতি শুক্রবার আমার এখানে একজন বিডিএস ডাক্তার বসেন। উনাকে দিয়ে দেখিয়ে দিব, শুধু শুধু চারশত টাকা ফি দিবেন আর কি। দেখবেন, আমি যেটা বলেছি, উনিও সেটাই বলবেন।" রহমান ভাই কথা শেষ করলেন। আমার কাজিন আকাশের মাধ্যমে রহমান ভাইয়ের খোঁজ পাওয়া। উনি প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং দক্ষতা সম্পন্ন, শুধুমাত্র একটা সার্টিফিকেটের অভাবে এই পাড়াগাঁয়ে পড়ে আছেন। নইলে......। আমার কাজিন রহমান ভাই সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা প্রদান করলো। এমন উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন লোকের ব্রিফিংয়ে আমার দাঁতের গর্তের অস্তিত্ব নিয়ে আমি নিজেই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেলাম। চেম্বার থেকে বেরিয়ে একটা দেশলাইকাঠি সংগ্রহ করে দাঁতের মাঝখান দিয়ে চালান দিতেই কাঠি যথারীতি ভেতরের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। দ্বিধা আরো প্রকট হলো। দাঁতে গর্ত নেই, এই কাঠি যায় কোথায়? যাইহোক, শুক্রবারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

হায়রে! এতবড় গর্ত বানাই রাখছেন দাঁতের ভিতর? উপর দিয়েতো বুঝার কোন উপায় নেই। সর্বনাশ করছেন।- অবাক নয়নে রহমান ভাইয়ের কথাগুলো গিলছিলাম। না গিলে কোন উপায়ও ছিল না৷ বিডিএস ডাক্তার 'চাকমা বাবু' আমার মুখের ফাঁকে এমন একটা কব্জা লাগিয়ে দাঁত পরীক্ষা করছিলেন যে, চেয়ে থাকা আর শোনা ছাড়া আমার আর কিছু করার উপায় ছিল না। সিদ্ধান্ত হলো 'রুট ক্যানেল' করে 'চিরস্থায়ী ফিলিং' দেওয়া হবে৷ দাঁত টিকে যাবে। যদিও ব্যায়বহুল, টেনশনের কোনই কারণ নেই; টাকা আস্তে আস্তে দিলেই হবে। রাজি না হওয়ার কোন কারণ ছিল না!

বেশ কিছুদিন পরের কথা। কুমিল্লা ব্রাঞ্চ ভিজিটে গিয়ে হোটেল নূরজাহানের কলিজা দেওয়া বড় সিঙ্গাড়া খাচ্ছিলাম। হঠাৎ ডানপাশের নিচের পাটির দাঁতে  কেমন যেন একটু ভিন্ন অনুভূতি পেলাম। সিঙ্গাড়ার কলিজাগুলো কেমন যেন শক্ত হয়ে উঠলো, স্বাদটা কেমন যেন অচেনা মনে হচ্ছিল। মনে সন্দেহ জাগলো। বেসিনে গিয়ে 'থু' করতেই আলুর সাথে মিশ্রিত সাদা রংয়ের কিছু শক্ত পদার্থ দৃষ্টিতে পড়লো। চোখ বড়বড় করে হোটেল ম্যানেজারের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার কালে আমার জিহবা গিয়ে স্পর্শ করলো নিচের পাটিতে 'চিরস্থায়ী ফিলিং' করানো আমার মূল্যবান দাঁতের মাঝখানটায়। একি! গর্ত গর্ত মনে হচ্ছে কেন? বেসিনের উপরে টানানো স্বচ্ছ আয়নায় হা করে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম যা হওয়ার হয়ে গেছে। আমার দাঁতের 'চিরস্থায়ী ফিলিং' পাঁচ বছরের মাথাই মূল্যহীন হয়েছে।

গত তিন চারদিন আগে মিন্টুদা'র কাছে গিয়ে ঐ দাঁতের শেষ অংশটাও ফেলে দিয়ে আসলাম। 'চিরস্থায়ী  ফিলিং' হারানোর ছয় মাসের মধ্যেই দাঁতের ভিতরের পার্ট হারিয়েছিলাম। এরপর থেকে বাইরের পার্ট দিয়ে কোন রকমে দৈনন্দিন কাজকর্ম চলছিল কিন্তু কয়েকদিন আগে কাতলা মাছের মাথার মুড়িঘন্ট খেতে গিয়ে চাপ পড়ে অবশিষ্ট বাইরের পার্টটাও নড়া শুরু করে। কিছুতো আর করার নেই। শেষমেষ, মিন্টু দা'র স্মরণাপন্ন হতে হলো।
আজ আমি ৩১ দাঁত বিশিষ্ট একজন অপরিপূর্ণ মানুষ।

Post Comment

No comments:

Post a Comment