Thursday, February 15, 2018

" বিজয় ও অভ্র " ----যাদের কল্যাণে আমরা বাংলায় কথা বলি

"আমি বাংলায় কথা বলি
আমি বাংলার কথা বলি"

তথ্য প্রযুক্তির এই চরম উৎকর্ষতার যুগে কলমের কালির পাশাপাশি কম্পিউটারের কি-বোর্ডকে যেমন অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই, তেমনি জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবে বই এর পাশাপাশি অনলাইনভিত্তিক তথ্যভাণ্ডারও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে শুরুতে কম্পিউটারের কি-বোর্ড শুধুমাত্র ইংরেজিতেই কথা বলত, আবার অনলাইন ভিত্তিক জ্ঞানের ভাণ্ডারকেও একসময় শুধুমাত্র ইংরেজিতেই কল্পনা করা যেত। 



সেকাল গেছে। আমাদের প্রাণের ভাষা বাংলা এখন কম্পিউটার এবং ইন্টারনেটে একটি বহুল ব্যবহৃত ভাষা। আমাদের মনের কথাটি এখন বাংলাতেই আমরা কি-বোর্ডে টাইপ করতে পারি; বাংলাতেই খুঁজে পাই যে কোন প্রয়োজনীয় তথ্য। আর এই জন্য যে দুজন ব্যক্তিকে বাঙ্গালী জাতি আজীবন স্মরণ রাখবে, তাদের একজন  বিজয় কি-বোর্ড এর উদ্ভাবক জনাব মোস্তাফা জব্বার এবং অন্যজন অভ্র কি-বোর্ড এর উদ্ভাবক জনাব মেহদী হাসান খান। 



বিজয় কি-বোর্ডঃ 

বিজয় কিবোর্ড হল মাইক্রোসফট উইন্ডোজম্যাক ওএস এবং লিনাক্স-এ গ্রাফিক্যাল লেআউট পরিবর্তক এবং ইউনিকোড ও এএনএসআই সমর্থিত বাংলা লেখার সফটওয়্যার। বিজয়ের উদ্ভাবক জনাব মোস্তাফা জব্বার। এটি একটি বাণিজ্যিক ক্লোজ সোর্স সফটওয়্যার।  বিজয় এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৮৮ সালে যা ইউনিকোড ভিত্তিক অভ্র কী-বোর্ড আসার পূর্বপর্যন্ত বহুল ব্যাবহৃত হয়েছে। ইউনিকোড পরিপূর্ণভাবে প্রচলনের স্বার্থে বিজয় এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে। প্রথম সংস্করণের সকল বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে দ্বিতীয় সংস্করণে এমন কিছু নতুন বর্ণ যুক্ত করা হয় যা ইউনিকোড ভিত্তিক বাংলা লেখার জন্য প্রয়োজন হয়। প্রকৃতপক্ষে বিজয় এর দ্বিতীয় সংস্করণ সম্পূর্ণ প্রয়োগ করা হয়েছে বিজয় এর ইউনিকোড এবং গোল্ড সংস্করণে।

অভ্র কি-বোর্ডঃ
অভ্র কিবোর্ড হল মাইক্রোসফট উইন্ডোজম্যাক ওএসউবুন্টু এবং লিনাক্স এর জন্য গ্রাফিক্যাল কী-বোর্ড সফটওয়্যার যা ইউনিকোড ও এএনএসআই সমর্থিত বাংলা লেখার বিনামূল্যের ও মুক্ত সফটওয়্যার। এই সফটওয়্যারটির অনন্য বৈশিষ্ট্য হল এতে ফোনেটিক (ইংরেজিতে উচ্চারণ করে বাংলা লেখা) পদ্ধতিতে বাংলা লেখা যায়। উইন্ডোজে ইউনিকোড ভিত্তিক বাংলা লেখার জন্য ২০০৩ সালের ২৬শে মার্চ অভ্র কীবোর্ড সফটওয়্যারটি আবির্ভূত হয়। এটার সাহায্যে বাংলা লিপি ব্যবহার করে বাংলার মত সব ভাষাতেই টাইপ করা যায়। এ ধরনের ভাষার মধ্যে অসমীয়া ভাষা অন্যতম। মেহদী হাসান খান নামে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্র ২০০৩ সালে অভ্র কীবোর্ড তৈরির কাজ শুরু করেন। তিনি এটি সর্বপ্রথম তৈরি করেছিলেন ভিজুয়াল বেসিক প্রোগ্রামিং ভাষা দিয়ে, পরবর্তীতে তিনি তা ডেলফিতে ভাষান্তর করেন। এই সফটওয়্যারটির লিনাক্স সংস্করণ লেখা হয়েছে সি++ প্রোগ্রামিং ভাষায়। পরবর্তীতে রিফাত-উন-নবী, তানবিন ইসলাম সিয়াম, রাইয়ান কামাল, শাবাব মুস্তফা এবং নিপুন হক এই সফটওয়্যারের উন্নয়নের সাথে যুক্ত হন। ২০০৭ সালে 'অভ্র কীবোর্ড পোর্টেবল এডিশন' বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্যে উন্মুক্ত করা হয়। অভ্র কীবোর্ডের সাম্প্রতিকতম সংস্করণ ৫.৫.০ গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ এ প্রকাশিত হয়। সফটওয়্যারটির আগের সংস্করণের লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম সমর্থিত সোর্সকোড আগে থেকেই মুক্ত ছিল এবং ২০১০ সালে উইন্ডোজে অভ্র কীবোর্ডের ৫ ভার্সনের সাথে এর সোর্স কোড মোজিলা পাবলিক লাইসেন্স এর আওতায় উন্মুক্ত করা হয়।

অভ্র-বিজয় বিতর্কঃ

কম্পিউটারে বাংলা লেখার বাণিজ্যিক ক্লোজ সোর্স সফটওয়্যার বিজয় কিবোর্ড এর স্বত্বাধিকারী এবং ‘আনন্দ কম্পিউটার্স’ এর প্রধান নির্বাহী মোস্তাফা জব্বার ৪ঠা এপ্রিল ২০১০ তারিখে দৈনিক জনকন্ঠের একটি নিবন্ধে অভ্রর দিকে ইঙ্গিত করে দাবী করেন যে- হ্যাকাররা তার ‘বিজয়’ সফটওয়্যারটি চুরি করে ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি অভ্র কীবোর্ডকে পাইরেটেড সফটওয়্যার হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি অভিযোগ করেন যে ইউএনডিপি হ্যাকারদের সহযোগিতা করেছে। তিনি আরও অভিযোগ করেন যে ইউএনডিপি-র প্ররোচনাতেই জাতীয় তথ্যভান্ডার তৈরির কাজে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন অভ্র কীবোর্ড ব্যবহার করেছে। মেহেদী হাসান খান জানান যে ক্লোজড সোর্স প্রোগ্রাম হ্যাক করা সম্ভব নয় বিধায় বিজয়ের সিস্টেম হ্যাক করা সম্ভব নয়। অপরদিকে, অভ্র'র পক্ষ থেকে মেহদী হাসান খান সকল নালিশ অস্বীকার করেন এবং অভিযোগ করেন যে, মোস্তাফা জব্বার বিভিন্ন পর্যায়ে ও গণমাধ্যমে তাদেরকে চোর বলেন এবং তাদের প্রতিবাদ সেখানে উপেক্ষিত হয়। কম্পিউটারে বাংলা নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের জন্য উকিল নোটিশ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দিয়ে আক্রমণের হুমকি উপেক্ষা করে কাজ করা স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা। তিনি আরো বলেন যে নির্বাচন কমিশনে জাতীয় পরিচয় পত্র প্রকল্পে বাণিজ্যিক বিজয়-এর পরিবর্তে বিনামূল্যের অভ্র ব্যবহার করাতে প্রায় ৫ কোটি টাকা লোকসান হওয়ায় মোস্তাফা জব্বার এমন অভিযোগ করেছেন। 

অভ্র ৪.৫.১ সফটওয়্যারের সাথে ইউনিবিজয় নামে একটি কীবোর্ড লেআউট সরবরাহ করা হয়। এই ইউনিবজয় কীবোর্ড লেআউট প্যাটেন্টকৃত বিজয় কীবোর্ড লেআউটের নকল দাবী করে মোস্তাফা জব্বার কপিরাইট অফিসে কপিরাইট আইন ভঙ্গের জন্য মেহেদী হাসান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এর ভিত্তিতে কপিরাইট অফিস খানকে কারণ দর্শাও নোটিশ পাঠায়। পরবর্তিতে মেহেদী হাসান খানের আবেদনের প্রেক্ষিতে এর সময়সীমা ২৩ মে ২০১০ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
১৬ জুন ২০১০ তারিখে ঢাকার আগারগাঁও এ অবস্থিত বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল অফিসে অনেক তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে মেহদী হাসান খান ও মোস্তাফা জব্বারের মধ্যে একটি সমঝোতা হয় এই মর্মে, ২০১০ সালের ২০ আগস্টের মধ্যে অভ্র কীবোর্ড সফটওয়্যার থেকে ইউনিবিজয় লেআউট সরিয়ে নেওয়া হবে এবং কপিরাইট অফিস থেকে মেহদী হাসান খানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত কপিরাইট লংঘনের অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। সেই চুক্তি অনুযায়ী, অভ্রর ৪.৫.৩ সংস্করণ থেকে ইউনিবিজয় কীবোর্ড বাদ দেওয়া হয়। তিনি অভ্র কর্তৃপক্ষের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানান।

যাই হোক, আমাদের জন্য বিজয় যেমন উপকারী তেমনি অভ্রও আমাদের কাছে অতি প্রিয়। সকল বিতর্কের অবসান হোক। " বিজয় ও অভ্র " -- কম্পিউটারে বাংলা লেখার দুই জায়ান্ট --যাদের কল্যাণে আমরা বাংলায় কথা বলি। 

তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট

Post Comment

No comments:

Post a Comment