অমৃত এর শাব্দিক অর্থ সুধা, পীযূষ, জীবন-বারি, অতিশয় সুস্বাদু খাদ্য ইত্যাদি। আর অরুচি অর্থ বিতৃষ্ণা বা অনিচ্ছা। অমৃতে কি কারো অরুচি হতে পারে? হয়, যখন অমৃত সুধা বিবেচনা বা মূল্যায়ন করার মতো জ্ঞান, দূরদর্শিতার ঘাটতি থাকে। সাহিত্য অমৃতসম, কিন্তু আজকালকার ঘুনে ধরা সমাজে সাহিত্য প্রীতি'র চেয়ে সাহিত্যে অরুচিই বেশি লক্ষিত হয়। সাহিত্য রস উপলব্ধি করার ক্ষমতা যার নেই, মানব জীবনে তার স্বার্থকতা কতটুকু? সাহিত্য চর্চা না করেই তথা অমৃতে অরুচি রেখেই আজকাল আমরা নিজেদের আধুনিক বলে দাবি করি, যা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়।
প্রাচ্যের সাহিত্য সমালোচক শ্রীশচন্দ্র দাস তাঁর 'সাহিত্য সন্দর্শন' গ্রন্থের ১৭নং পৃষ্ঠায় সাহিত্যের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছেন- ''নিজের কথা, পরের কথা বা বাহ্য-জগতের কথা সাহিত্যিকের মনোবীণায় যে সুরে ঝংকৃত হয়, তাহার শিল্পসংগত প্রকাশই সাহিত্য।''
সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-''অন্তরের জিনিসকে বাহিরের, ভাবের জিনিসকে ভাষার, নিজের জিনিসকে বিশ্বমানবের ও ক্ষণকালের জিনিসকে চিরকালের করিয়া তোলাই সাহিত্যের কাজ।''
ডাঃ লুৎফর রহমান সাহিত্যের এ ব্যাপকতাকে লক্ষ্য করে স্মরণযোগ্য একটি মন্তব্য করেছেন। মন্তব্যটি হলো- ''জীবনের কল্যাণের জন্য, মানুষের সুখের জন্য এ জগতে যিনি যত কথা বলিয়া থাকেন,- তাহাই সাহিত্য।''
সাহিত্যের আরো কিছু সংঙ্গা দেখে নেওয়া যাক-
"বস্তুত বহিঃপ্রকৃতি এবং মানবচরিত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অনুক্ষণ যে আকার ধারণ করিতেছে, যে সংগীত ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে, ভাষা রচিত সেই চিত্র এবং গানই সাহিত্য।- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
"মানুষ ও কবিতা অবিচ্ছেদ্য। মানুষ থাকলে বুঝতে হবে কবিতা আছে : কবিতা থাকলে বুঝতে হবে মানুষ আছে।"- হুমায়ূন আজাদ।
"সাহিত্যের কাজ মানুষকে তার চারিদিককার মন্দ শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী করে তোলা।তার মধ্যে সমাজ বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনকে অগ্রাহ্য করে ন্যায়, সত্য ও আল্লাহকে মেনে নেবার প্রবৃত্তি করে দেওয়া।- লুৎফর রহমান।
"পরিচ্ছন্ন বই পড়া ভাল, কিন্তু মহান সাহিত্যের পঠিত বিষয় জীবনে বুনন করা উত্তম।" - মহাত্মা গান্ধী।
"চুরি এবং ফাঁকিবাজি চলে রাজনীতি, ব্যবসা আর অর্থনীতিতে। সংগীতে, শিল্পে আর সাহিত্যে নয়।"- আবুল ফজল।
"বই পড়ার অভ্যাস নেই আর পড়তে জানেনা এমন লোকের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।"- মার্ক টোয়েইন।
একবার সৈয়দ শামসুল হককে একটা সাক্ষাৎকারে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল মানব জীবনে ও সমাজে শিল্প-সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা কি। উনি তখন উত্তরে যা বলেছিলেন তা অনেকটা এরকম যে আমরা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নিত্য প্রয়োজনীয় অনেক কিছু ব্যবহার করি যা শিল্প-সাহিত্যের অবদান। এই যে চমৎকার সব ডিজাইনের বাহারী জানালার পর্দা, সুন্দর সুন্দর বিছানার বেড কভার এসব চিত্র শিল্পীরা আকেঁ, সময়ের বিবর্তে এগুলো একসময় বাজারে চলে আসে, আমাদের নিত্য ব্যবহার্য হয়ে যায়। সাহিত্যের বেলায়ও সেরকম। এই যে আমরা গুছিয়ে কথা বলি, সুন্দর শব্দ চয়ন করি, ভাষার অলংকরণ করে নিজেদের ভাব, মতামত প্রকাশ করি, পণ্যের প্রচারে, বিজ্ঞাপনে মনকাড়া সংলাপ ব্যবহার করা হয়– এসবই সৃজনশীল সাহিত্যের চর্চা ও পাঠের পরোক্ষ প্রকাশ ও ব্যবহার।
আমরা আধুনিক হতে চাই, সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলতে চাই, রুচিশীলতার প্রকাশ ঘটাতে ইচ্ছুক; আমরা নিজেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে উন্মুখ, জীবনের কল্যান নিয়ে ভাবতে চাই, অন্যকে সুখী করার শপথ নিই, মন্দ শক্তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে চাই, আমরা চুরি, ফাঁকিবাজির বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থানে যেতে দৃঢ় প্রত্যয়ী, আমরা নিজেদের জ্ঞানী দাবি করি অথচ আমরা সাহিত্য বিমুখ। এরচেয়ে বড় উপহাস আর কি হতে পারে? গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢাললে যেমন গাছ বাঁচে না; তেমন সাহিত্য বিমুখ হয়ে আধুনিকতার স্বপ্ন দেখা নিতান্তই বাড়াবাড়ি বা দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।
সাহিত্য পাঠ করার তথা অমৃত রস আস্বাদন করার সময় আমাদের নেই। সাহিত্য আলোচনায় আমাদের আগ্রহ নেই। সাহিত্য রচনাকারীকে উৎসাহিত করতে আমরা কুন্ঠাবোধ করি। সন্দেহ জাগে, আসলে আমাদের গন্তব্য কোথায়? আমরা কিসের পিছনে ছুটছি? আমরা কি সত্যিই মানুষ হতে পারছি? অমৃতে আমাদের অরুচি জন্মেছে, পচন আমাদের অনিবার্য।
No comments:
Post a Comment