Saturday, May 30, 2020

এক বিকেলের গল্প


বাইরে মূষল ধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে, সাথে বজ্রপাত। ছোট্ট কিশোর গুটিশুটি মেরে তার বাবার কোলে বসে আছে। বারান্দায় আরামকেদারায় বসে বৃষ্টি দেখা বাবুল সাহেবের দীর্ঘদিনের অভ্যেস। বিশেষ করে ছুটির দিনে বৃষ্টি হলে আর কোন কথাই নেই; বাবুল সাহেব রবী ঠাকুরের গান চালিয়ে দিয়ে আরামকেদারা বিছিয়ে বারান্দায় বসে পড়েন। মিসেস বাবুল পেঁয়াজ কেটে মুড়ি-চানাচুর মেখে দেন, সাথে অল্প পাতা দিয়ে রং চা। আগে এ সময়টা বাবুল সাহেব একা কাটাতে পছন্দ করতেন। তবে ইদানীং পাঁচ বছর বয়সী কিশোর তাঁর সঙ্গী হয়। বাবুল সাহেবের খারাপ লাগে না। একসময় উঠোনে পড়তে থাকা বৃষ্টির ফোঁটার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকে তিনি যে আনন্দ উপভোগ করতেন, আজকাল বৃষ্টির ছন্দে ছন্দে অবুঝ কিশোরের হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে তিনি যেন একই আনন্দ উপভোগ করেন। জন্মের পর থেকে দূর্ভাগা কিশোরই তো তাঁর সব। প্রথম প্রথম ছেলেটার দিকে তাকালে পানিতে চোখ ভিজতো বাবুল সাহেবের। এখন অনেকটাই সয়ে গেছে। তিনি তো সাধ্যের বেশি চেষ্টা করে যাচ্ছেন, বাকিটা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা। স্বাভাবিকভাবেই কিশোরের সাথে আচরণ করেন পরিবারের সবাই, যাতে তার মনে কোন নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।

বাবুল সাহেবের একা বাড়ি। মফস্বল শহরের পাকা রাস্তার পাশেই একতলা দালান ঘর। চারপাশে সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়ির উঠোনটা বেশ বড়। বাড়ির বাসিন্দা মাত্র চার জন। মিস্টার ও মিসেস বাবুল, তাঁদের একমাত্র সন্তান কিশোর এবং বাবুল সাহেবের বৃদ্ধা মা। বাবুল সাহেবের বাবা চাঁন মিয়া গত হয়েছেন বছর চারেক আগে। মূলতঃ তিনিই এ বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। একসময় চাঁন মিয়া স্ব-পরিবারে গ্রামের বাড়িতে বাস করতেন। এগার জন ভাইবোনের মধ্যে চাঁন মিয়া ছিলেন পঞ্চম। ছোট বাড়িতে খুব আটসাঁট জীবন যাপন ছিল তাঁদের। মেধাবী শিক্ষার্থী চাঁন মিয়া এইচএসসি পাশ করেই ভূমি অফিসে 'অফিস সহকারী' পদে চাকরি পেয়েছিলেন। আরো লেখাপড়া করার ইচ্ছে থাকলেও বাস্তবতার নিরিখে তা আর হয়ে উঠে নি। চাকরির শুরু থেকেই খুব হিসেবী জীবন যাপনের ফলস্বরুপ এই জায়গা কেনার সামর্থ্য অর্জন করেছিলেন চাঁন মিয়া। চাঁন মিয়ার মা-বাবা মারা যাওয়ার পর ভাগের যৎসামান্য স্থাবর সম্পত্তি মেজো ভাইয়ের কাছে বিক্রি করে স্ব-পরিবারে নিজের কর্মস্থল এই মফস্বল শহরে পাড়ি জমান চাঁন মিয়া। বেড়ার ঘেড়া ও টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট্ট একটা ঘর তৈরি করে তাতেই পরিবার সহ বসবাস করা শুরু করেন চাঁন মিয়া। বাবুল সাহেব তখন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে নিজের কষ্টার্জিত টাকায় আস্তে আস্তে এই জায়গার উপর একতলা দালানটি নির্মাণ করেন চাঁন মিয়া।

আজকের বৃষ্টিটা বাবুল সাহেবের কাছে উপভোগ্য মনে হচ্ছে না।  বৃষ্টির ছন্দ আজ যেন বিরহের সুর তুলেছে। কিছুক্ষণ পরপর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছে তাঁর বুকের গভীর থেকে। চিরচেনা উঠোনের দিকে তাকিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে। তাঁর শৈশব, কৈশোর, যৌবন কেটেছে এই উঠোনে, এই বাড়িতে। কত স্মৃতি চোখের কোনে ভেসে উঠতে লাগলো। শীতের সকালে এই উঠোনে বসে রৌদ পোহাতে পোহাতে ভাপা পিঠার সাথে খেজুরের রস, গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে বাবার সাথে গামছা বিছিয়ে এই উঠোনে গাছের ছায়ায় শুয়ে থাকা, বর্ষাকালে মায়ের কড়া শাসন ফাঁকি দিয়ে এই উঠোনে বৃষ্টিতে ভেজা, নীলুর সাথে প্রথম দেখাটাও এই বাড়িতেই, কিশোরের জন্ম; যেন এক সপ্তাহ উৎসব ছিল এই বাড়িতে, এই বাড়ির প্রতিটি দেয়াল; প্রতিটি মাটির কনা; প্রতিটি গাছ-গাছালি তাঁর চিরচেনা, কোথাও বেড়াতে গেলে কোনরকমে এক রাত থেকেই আবার ফিরে আসতেন এই বাড়ির মায়ায়, কখনো হাসি; কখনো দুঃখ; কতশত ঘটনা প্রবাহের নিরব স্বাক্ষী এই ভবন; এই উঠোন; এই বাড়ি, বাবার লাশটাও অন্তিম যাত্রায় রওনা হয়েছিল এ বাড়ির উঠোন থেকে- বাবুল সাহেব আর ভাবতে পারেন না। তার বুকটা খুব ভারী হয়ে গেছে। এবার তিনি তাকালেন কিশোরের দিকে৷ ছেলেটা নির্ভাবনায় তাঁর কোলে বসে উঠোনে হাঁসের জলকেলি দেখছে। বাবুল সাহেব বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিলেন। নিজের আবেগ সংবরণ করার চেষ্টা করলেন। মনে মনে ভাবলেন, তিনি অবশ্যই ঠিক করছেন। অধিক গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ রক্ষায় অল্প গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বিসর্জন দিতেই হয়, এটিই জগতের নিয়ম।

বৃষ্টি থেমে গেছে। সূর্যটা ডুবে যাওয়ার আগে শেষ বিকেলের আভা ছড়াচ্ছে। বাবুল সাহেব বারান্দা হতে আস্তে আস্তে শোবার ঘরে প্রবেশ করলেন। কিশোর চলে গেলো তার দাদির ঘরে। মিসেস বাবুল শেষ বারের মতো দেখে নিচ্ছেন কিছু রয়ে গেল কিনা। ট্রাক বলা হয়ে গেছে। কাল সকালেই ট্রাক আসবে, মালপত্র সব নিয়ে যেতে যেতে দুপুর হয়ে যাবে; এরপর হাজারো মায়ার বন্ধন ছিন্ন করে, চিরচেনা এই বাড়ি ছেড়ে স্ব-পরিবারে বাবুল সাহেব চলে যাবেন পাশের মহল্লার তিন রুমের ভাড়া বাড়িতে। বাবুল সাহেব নিরূপায়। শিক্ষকতার সীমিত আয়ে এতো টাকা জোগাড় করার মতো আর কোন পথই যে খোলা ছিল না তাঁর সামনে! বাড়ির নতুন মালিক কি তাঁদের স্মৃতিচিহ্নগুলো ধরে রাখবেন? কেন রাখবেন? চোখের কোনে আবার জল জমতে লাগলো বাবুল সাহেবের।

বিমানের টিকিট নিশ্চিত করা হয়েছে। বাবুল সাহেব ও কিশোর যাবে। মিসেস বাবুল বাসাতেই থাকবেন। বৃদ্ধা শাশুড়িকে একা রেখে তাঁর পক্ষে স্বামী-সন্তানের সঙ্গী হওয়া সম্ভব নয়। আগামী শনিবার ঢাকা থেকে ফ্লাইট। দেশে অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন কিন্তু ছোট্ট কিশোরের হার্টের ছিদ্রটা দিনদিন বড় হয়ে যাচ্ছে; সুচিকিৎসার জন্য চেন্নাই যাওয়ার আর কোন বিকল্প নেই। বাবুল সাহেব মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে ট্রাকের ড্রাইভারকে ফোন দিলেন।

Post Comment

No comments:

Post a Comment