শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় নামটির সাথে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯৫ সালের দিকে। তখন আমি ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি আসতো আমাদের বিদ্যালয়ে, মাসে সম্ভবত দু'বার। প্রতিবার দুটি করে বই পেতাম পড়ার জন্যে। খুব আনন্দ নিয়ে পড়তাম বইগুলো। পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়াতে তখন অভিভাবক ও শিক্ষকগণ আমাদের উৎসাহিত করতেন। বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি থেকেই একবার একটা বই পেয়েছিলাম 'ঝিন্দের বন্দী', লিখেছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। এটি একটি উপন্যাস। খুব আনন্দ পেয়েছিলাম বইটি পড়ে।
একই সাথে বন্ধুত্ব, প্রেম, রহস্য, এডভেঞ্চার ও ট্রাজেডি নির্ভর এই উপন্যাসের কাহিনী মধ্যভারতের ছোট্ট রাজ্য ঝিন্দ-কে কেন্দ্র করে। ঐ রাজ্যের রাজার মৃত্যু হলে সিংহাসন নিয়ে রাজার দুই পুত্র শংকর ও উদিতের দ্বন্দ হয়। রাজা হওয়ার জন্য মনোনীত শংকর শপথ গ্রহণের কয়েকদিন পূর্বে হঠাৎ নিঁখোজ হয়ে যায়। বিশ্বস্ত রাজকর্মীরা বিপাকে পড়ে গিয়ে কি করবেন ভেবে যখন কিংকর্তব্যবিমুঢ় ঠিক তখনই তারা সন্ধান পান গৌরি নামক এক বাঙালি যুবকের, যার চেহারা হুবুহু হারিয়ে যাওয়া শংকরের মতো। উদিতের হাত থেকে রাজ্যকে রক্ষা করতে রাজকর্মীরা গৌরী কে শংকর হিসেবে উপস্থাপন করে ঐ রাজ্যের রাজা বানায়। কিন্তু উদিত ব্যাপারটা মেনে নিতে নারাজ কারণ শংকর প্রকৃতপক্ষে নিঁখোজ ছিল না বরং বন্দী ছিল। এভাবে বিভিন্ন নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে 'ঝিন্দের বন্দী' উপন্যাসের কাহিনী। উপন্যাসটি আমার কোমল মনে দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছিল এবং শরবিন্দু বাবুর চমৎকার লিখন শৈলীতে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। পরবর্তীতে জানতে পারি এই উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে 'ঝিন্দের বন্দী' নামেই চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছিল ১৯৬১ সালে, যাতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন কিংবদন্তি অভিনেতা উত্তম কুমার। আবার ২০১৫ সালে সালমান খান অভিনীত বলিউড চলচ্চিত্র 'Prem Ratan Dhan Payo' - এর কাহিনীও মূলতঃ 'ঝিন্দের বন্দী' উপন্যাস হতে নেওয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। তবে এ চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি কোন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৮৯৯ সালের ৩০ মার্চ উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর শহরে। তিনি কলকাতায় বিদ্যাসাগর কলেজে আইন নিয়ে পড়াশুনো করেন। পড়াশুনোর সাথেই তিনি সাহিত্য চর্চাও করতেন। তাঁর রচিত প্রথম সাহিত্য প্রকাশিত হয় মাত্র ২০ বছর বয়সে। সাহিত্য চর্চাই ছিল তাঁর প্রধান নেশা, পাশাপাশি ১৯৩৮ সালে বম্বের 'বম্বে টকিজ' এ চিত্রনাট্যকাররূপে কাজ শুরু করেন।
'কালের মন্দিরা', 'গৌর মল্লার', 'তুমি সন্ধ্যার মেঘ', 'তুঙ্গভদ্রার তীরে', 'জাতিস্মর', 'বিষের ধোঁয়া' ইত্যাদি উপন্যাস তাঁর অমর সৃষ্টি। ছোটগল্প ও শিশুসাহিত্য রচনাতেও পারদর্শী ছিলেন। তবে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র হল ব্যোমকেশ বক্সী। ব্যোমকেশ একজন ডিটেকটিভ। নিজেকে তিনি সত্যান্বষী বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। তাঁর রচনা অনুসারে 'ব্যোমকেশ বক্সী' চরিত্রটি বিভিন্ন সময় কমিকস আকারে প্রকাশিত হয়েছে এবং বিভিন্ন সময় এ চরিত্র চিত্রায়ণ হয়েছে; যে চরিত্রে উত্তম কুমার, সুদীপ মুখোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, যীশু সেনগুপ্তসহ বিভিন্ন খ্যাতনামা অভিনেতাগণ অভিনয় করেন।
ভাবী, বচন, দুর্গা, কঙ্গন, নবজীবন, আজাদ, পুনর্মিলন— এই সাতটি বম্বের ছবির গল্প লিখেছিলেন শরবিন্দু। তিনি ইংরেজিতে লিখতেন, যা হিন্দিতে অনুবাদ করে নেওয়া হতো। দুর্গা (১৯৩৯), কঙ্গন (১৯৩৯), নবজীবন(১৯৩৯) ও আজাদ (১৯৪০) চলচ্চিত্রগুলোর চিত্রনাট্যকার ছিলেন শরবিন্দু। তাঁর লেখা 'চিড়িয়াখানা', 'ঝিন্দের বন্দী', 'বিষের ধোঁয়া', 'দাদার কীর্তি', 'মরু ও সঙ্ঘ' উপন্যাসসমূহের কাহিনী অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার, শরৎস্মৃতি পুরস্কার, মতিলাল পুরস্কার প্রভৃতি পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৭০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ভারতের মুম্বাইয়ে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়।
No comments:
Post a Comment