Sunday, April 18, 2021

মানসিকতা!!!

 একবার একজন গাড়ির কোম্পানির সাথে বসে বসে গল্প করছিলাম। একপর্যায়ে তাকে বললাম- ভাই, ভালো গাড়ি টাড়ি পেলে জানাবেন; আপনাদের মতো ব্যবসাবাণিজ্য কিছু করতে পারি কিনা দেখি। সে উত্তরে আমাকে বললো- ভাই, লুঙ্গি কোমরের উপর তুলে মানুষের মা'কে গালি দেওয়ার অভ্যাস আছে? অবাক চোখে তাকিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম- কেন ভাই? সে বলল- ভাই, লুঙ্গি কোমরের উপর তুলে মানুষের মা'কে গালি দেওয়ার অভ্যাস না থাকলে এ ব্যবসা করতে পারবেন না। ড্রাইভার আর স্টাফরা ডেইলি তিনবার করে আপনাকে বেচে চারবার করে কিনবে; লাভতো কিছু হবেই না বরং জমাজাটি যা আছে বছরখানেকের মধ্যে শেষ করে খালি পায়ে ঘরে ফিরতে হবে। 'লেবার ফাংশন' এতো সহজ না ভাই; সে যুক্ত করলো।

আমার পরিচিত একজন লোক 'মীরসরাই ইকোনমিক জোন'- এ 'লেবার' সাপ্লাই দেয়। একদিন কথা প্রসঙ্গে তাকে বললাম- ভাই, টাকা পয়সা তো ভালোই কামাচ্ছেন। উত্তরে সে বললো- ভাই, টাকা পয়সা কামাচ্ছি, ঠিক আছে। তবে বুঝেন তো ভাই 'লেবার ফাংশন'; অনেক ঝামেলা, সুখ নাই। আমি আবার বললাম- কি বলেন, ভাই? কাজ তো করে ওরা, আপনি তো কমিশনের মালিক। আপনার আবার ঝামেলা কিসের? উনি উত্তর দিলেন- ভাই, এটা ছাত্র পড়ানো না, এটা 'লেবার ফাংশন'; এইসব ছোটলোকদের নিয়ে কাজ করতে অনেক ঝামেলা আছে।

সিনিয়র একজন ভাই একটা অফিসে বড় পদে চাকুরী করেন। একদিন উনার অফিসে গিয়ে উনার অনুপস্থিতিতে অফিসের পিয়নের সাথে খুব গল্প শুরু করে দিলাম। গল্প চলতে চলতে আমি ও সেই পিয়ন দু'জন একে অন্যকে ভাই বলে সম্বোধন করছিলাম এবং খুব মন খুলে হাসছিলাম। এমন সময় বড় ভাই আসলেন, পিয়ন রুম থেকে চলে গেল, বড় ভাইয়ের সাথে এই-সেই কথা হচ্ছিল। একপর্যায়ে বড় ভাই বললেন, পিয়ন-টিয়ন এরা হলো 'লেবার' শ্রেণির লোক, এদের বেশি আস্কারা দেওয়া ঠিক না; মাথায় উঠে যায়। ওদেরকে ওদের অবস্থানেই রাখতে হয়- বড় ভাই যোগ করলেন।

এমন হাজারো উদাহরণ আছে। আমি এমনও দেখেছি, কিছুদিন আগে 'লেবার' থাকা লোকটি একটু ভালো অবস্থানে পৌঁছে তার অধীনস্থ 'লেবার' শ্রেণির লোকদের সাথে 'লেবার ফাংশন' এর মতোই আচরণ করেছেন। নিজের অতীত তাকে এতোটুকু কোমল করতে পারে নি।

মূলতঃ আমরা সবাই 'লেবার' কারণ সবাই কারো না কারো অধীনে কাজ করি। আমরা যার অধীনে কাজ করি সে আমাদের 'লেবার' ভেবে 'ডোমিনেট' করে আবার আমাদের অধীনে যারা কাজ করে তাদের আমরা 'লেবার' বানিয়ে 'ডোমিনেট' করি। আমি একবার একটা স্কুলে গিয়ে দেখেছিলাম, প্রধান শিক্ষক নিজে স্কুল ফান্ড থেকে নিয়মিত নাস্তা করেন কিন্তু অন্যান্য শিক্ষকদের নাস্তা করতে হয় নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। অর্থাৎ প্রধান শিক্ষক এক্ষেত্রে অন্যান্য শিক্ষকদের 'লেবার' হিসেবে গণ্য করে স্কুল ফান্ড থেকে তাদের নাস্তা করার অধিকার হরণ করেছেন। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষ্য করলে এমন 'ডোমিনেটিং চিত্র' চোখে পড়ে। 

তবে সাধারণত 'লেবার শ্রেণি' বলতে আমরা যাদের জানি, তারা একেবারে নিচের পর্যায়ে অবস্থান করে। সকল উৎসের পানি নিচের দিকে গড়াতে গড়াতে সর্বশেষ তাদের উপর গিয়েই সর্বসাকুল্যে পতিত হয়। ফলে তারা 'মোস্ট ডোমিনেটেড'।

নিজ নিজ মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। কে কি করলো না করলো, তা না ভেবে আমরা নিজেরা কি করছি; তা নিয়ে ভাবতে হবে। আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনা বা সুযোগ বা পরিবেশ এখন আর নেই বললেই চলে; নিজের বিবেক দিয়ে নিজেকে ভালোর পথে পরিচালিত করতে হবে। মনের পশুত্বকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। এভাবেই হয়তো একদিন সমাজে ঘটে যাবে এক নীরব বিপ্লব। 

আমাদের আশেপাশে কয়জন আছে- যারা দূর্বলের উপর 'ডোমিনেট' করে না? 'লেবার শ্রেণি'কে তাদের প্রাপ্য অধিকার দেয়? 'লেবার'দের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য করে? ঘাম শুকানোর আগে 'লেবার' এর পাওনা পরিশোধ করে? সংখ্যাটা খুব কম। কিন্তু মুখে বড় বড় বুলি আওড়ানোর লোকের অভাব নেই। কিন্তু বাস্তবে 'লেবার' হলো আমাদের কাছে একধরণের জঘন্য, নিচু, অস্পৃশ্য, নিকৃষ্ট শ্রেণির কিছু মানুষ। এ ধারণা নিয়েই বেড়ে উঠছে আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম। 

কাল বাঁশখালীতে যা ঘটেছে, তা আমাদের দীর্ঘদিনের সামাজিক ব্যাধির ছোট্ট একটা ফলাফল মাত্র। এমন আরো অনেক ঘটনা নিয়মিত ঘটছে এবং ভবিষ্যতে ঘটার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে ধারণা করা যায়।  

'লেবার' হত্যার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

Post Comment

No comments:

Post a Comment