Sunday, June 30, 2013

অমানুষ

এই গল্পের নায়ক "সুমন"। যেহেতু গল্পের নাম "অমানুষ" তাই সহজেই বুঝতে পারছেন এই গল্পের নায়ক হতে হলে কত বড় অমানুষ হতে হয়। হুম, সুমন আসলেই অনেক বড় মাপের অমানুষ, তাই সে এই গল্পের নায়ক।

সুমনের বাড়ি বাগেরহাট। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারের সন্তান সুমন। সুমনরা তিন ভাই, তিন বোন। ভাই বোন দের মধ্যে সুমন পাঁচ নম্বর। মা বাবা তেমন লিখাপড়া জানেন না তবে সবকটা ছেলে মেয়েকে লিখাপড়া করিয়েছেন। সুমনরা সব ভাই বোন ডিগ্রি পাস।

ছোট বেলা থেকে সুমন অত্যন্ত চালাক এবং খুব হিসাবী প্রকৃতির, লাভ ছাড়া এই জীবনে সে এই পর্যন্ত কোন কাজ করেনি। আশে পাশের লোকজন সুমন এর সাথে কথা বলতে অনেক হিসেব নিকেশ করে বলে। সবাই তার সাথে কথা বলতে কোন প্যাঁচ এ পড়ে যাবার অজানা আশংকায় ভুগে। এই জীবনে এই পর্যন্ত অনেককে ফাঁসিয়েছে সুমন। তার বুদ্ধির দৌড়ে তার সাথে কেউ পেরে উঠে না। স্মৃতি শক্তি অনেক ভাল। তাছাড়া সে মুখের কথায় বিশ্বাসী নয়, যে কোন বিষয় লিখে রাখে এবং সময় মত কাজে লাগায়। তার সম্পর্কে তার বাবা মা মিশ্র অনুভূতি অনুভব করেন। তাঁরা কখনো ভাবেন, এই যুগে এমন না হলে চলা যায় না আবার যখন কোন এক মারপ্যাঁচ দিয়ে মা বাবার কাছ থেকে বছরের ধান বেচার অর্ধেক অর্থ হাতিয়ে নেয় তখন তাঁরা ভাবেন, হায় আল্লাহ এ কি ছেলে দিলা আমাদের, আমাদের তো আরও দুই টা ছেলে আছে কই তারাতো কখনো এমন করে না !

ডিগ্রি পাস করার পর সুমন সারাদিন বাড়িতে সময় কাটাত। কখনো শুয়ে বসে, কখনো গান শুনে আবার কখনো এরপর কাকে ফাঁদে ফেলবে তা চিন্তা করে করে। মা বাবা মাঝে মাঝে এসে বলতেন, কিরে বাবা, ডিগ্রি পাস করলি এখন একটা চাকরী বাকরি দেখ। সুমন উত্তর দিত, আমি ডিগ্রি পাস, আমি চাকরী খুঁজব কেন? চাকরী আমাকে খুঁজবে। তারপর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে পায়ের উপর পা তুলে একটা গ্র্যাজুয়েট মার্কা ভাব নিয়ে মা বাবার মুখের দিকে তাকাত। একটা শুকনা হাসি দিয়ে মা বাবা বিদায় নিতেন। মাঝে মাঝে সুমনের বাবা আশে পাশের লোকজনদের সুমনের জন্য একটা চাকরী দেখতে বলতেন কিন্তু এই "আগুনের গোলা" র জন্য কেউ রিস্ক নিতে স্বাভাবিক কারনেই রাজি হতেন না।

সুমনকে নিয়ে সুমনের মা বাবার চিন্তা দিন দিন বাড়তে লাগল। সুমনের বাবাকে সবাই বুদ্ধি দিলেন ছেলে বড় হয়েছে, ডিগ্রি পাস করছে, এইবার বিয়ে করায় দাও। বউয়ের ঠেলায় পড়ে ঠিক হয়ে যেতে পারে। সুমনের বাবা সকলের কথা মেনে নিয়ে ছেলের কাছে বিষয়টি পাড়লেন। সুমন বিয়ে করতে রাজি হল কিন্তু শর্ত হল চাকুরী করা মেয়ে হতে হবে। অনেক খোঁজ খবর শেষে খুলনার এক মেয়ের সাথে সুমনের বিয়ে পাকা হল। মেয়ের নাম মুক্তা। মুক্তা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করত। ঘটা করে বিবাহ কাজ সম্পাদন করা হল।

বিয়ের পর বউয়ের সাথে সুমন খুব ভাল ব্যাবহার করত। মুক্তাও এমন একটা জামাই পেয়ে খুব খুশি হল। মুক্তার চাকুরীর সুবাদে সুমন ও মুক্তা খুলনা শহরে একটি ছোট বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করা শুরু করল। মুক্তা সকালে সারাদিনের খাবার তৈরি করে, সুমনকে খাইয়ে, নিজে খেয়ে, টেবিলের উপর সুমনের হাত খরচের টাকা রেখে অফিসে চলে যেত। ফিরত সন্ধ্যায়, ফিরে আবার রাতের খাবার তৈরি করে সুমন সহ খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। আর সুমন বাসায় টিভি দেখে, পাড়ার চায়ের দোকানে আজাইরা আড্ডা মেরে, ঘুমিয়ে সারাদিন পাড় করত। এভাবেই দিন কেটে যেতে লাগল। মুক্তা তাকে কিছুই বলত না, আসলে সুমনের এমন মধুর আচরনে মুক্তা সবসময় বিমোহিত হয়ে থাকত।

প্রায় দু'মাস কেটে যাবার পর একদিন মুক্তা সুমনকে বলল, এই যে সারাদিন বাসায় বসে থাক তোমার খারাপ লাগে না। সুমন হাসি মুখ করে উত্তর দিল, হ্যাঁ লাগে কিন্তু সন্ধ্যায় যখন তোমার চাঁদ মুখটা দেখি তখন আমার সব খারাপ লাগা ম্লান হয়ে যায়। সারাদিন ধরে তোমার প্রতিক্ষায় থাকি, তুমি কখন আসবে, কখন তোমার চোখে আমার পৃথিবী টা দেখব। মুক্তা বরাবরের মত আহ্লাদিত হল। তারপর বলল, তুমি যদি চাও তোমার জন্য আমি একটা চাকরী জোগাড় করে দিতে পারি, সারাদিন কাজে বেস্ত থাকলে সময় খুব সহজে কেটে যাবে। আমাকে দেখার প্রহর তোমার কাছে ছোট মনে হবে। সুমন একটু চিন্তা করে বলল, আচ্ছা দেখ কিন্তু তুমি তো জান আমি ডিগ্রি পাস, ওই লেভেল এর চাকরী হতে হবে কিন্তু। মুক্তা খুব খুশি হল।

একটা বিস্কিট কোম্পানির "বিক্রয় প্রতিনিধি" পদে সুমনের চাকুরী হল।

যেদিন থেকে সুমন চাকুরীতে যোগদান করল, সেদিন থেকে সে আস্তে আস্তে বদলে যেতে লাগল। তার ব্যাবহার আস্তে আস্তে মন্দ হতে লাগল। মুক্তার সাথে যখন তখন রাগ দেখাতে লাগল। মুক্তা একটু বিচলিত হলেও মনে মনে ভেবে নিল, সারা জীবন অনেক আরামে কাটিয়েছে তাই চাকুরীর ধাক্কা সামলে নিতে একটু সময় লাগছে, তাই হয়তো সুমন এর আচরনের এই পরিবর্তন। কিন্তু সময় যত যাচ্ছিল সুমনের আচরন দিন দিন আরও খারাপ হচ্ছিল। একসময়, মুক্তার নিজের কাছে নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছিল। সে মনে মনে নিজেকেই দোষারোপ করছিল কারন সেইতো সুমনকে চাকুরীর বেবস্থা করে দিয়েছে, চাকুরী পাওয়ার পরই তো সুমন এমন বদলে যাচ্ছে।

সময়ের সাথে সাথে আস্তে আস্তে এখন আর সুমনের সাথে মুক্তার তেমন একটা কথা বার্তা হয় না। একছাদের নিচে দু'জন ঠিকই বসবাস করে কিন্তু দু'জনার এখন আলাদা পৃথিবী। মুক্তা রাতে একা বিছানায় ডুকরে ডুকরে কাঁদে। ইতিমধ্যে মুক্তা সুমনের অফিসে খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পেরেছে, সুমন ঠিক ঠাক মত অফিস করে না, সকালে দেরিতে কাজে যায় আবার অফিস শেষ হবার আগেই বিদায় হয়। মুক্তা আরও একটু খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারল সুমনের অফিসের পাশেই এক মেয়ের সাথে এখন সুমনের চক্কর চলছে। মেয়ে খুব সুন্দরী। মেয়ের বাবা ও ভাই ইতালি থাকে। সুমন শুধু মেয়েকে নয়, মেয়ের মাকেও ইতিমধ্যে বাগে নিয়ে এসেছে। মেয়ের মা সুমন কে কথা দিয়েছে যে সুমন যদি মুক্তাকে ছেড়ে আসতে পারে তাহলে তার মেয়েকে তিনি সুমনের কাছেই বিয়ে দিবেন। আর বিয়ের পর বউ সহ ইতালি। জায়গা বরাবর হাত দিয়েছে সুমন।

সব জেনে একদিন মুক্তা সুমনকে জানাল যে সে "মা" হতে যাচ্ছে। সুমন মুখে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল , Congratulation. মুক্তা একটু অবাক হল। তারপর আবার নীরবতা। দু'জন দু'দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।

এর এক সপ্তাহ পরের কথা, একদিন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হল, সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত এল, রাত পেরিয়ে সকাল হল সুমন বাসায় ফিরল না। সুমনের ফোন বন্ধ পাওয়া গেল। মুক্তা অনেক খোঁজা খুঁজি করল, সুমনের বাসা ও আত্মীয় স্বজন দের কাছে ফোন করল কিন্তু কোথাও সুমনের কোন খবর পেল না। সবশেষে মুক্তা খোঁজ নিল সেই মেয়েটির বাসায়, বাসা থেকে জানানো হল, মেয়েটি ঢাকা বেড়াতে গেছে তার খালার বাসায়। সুমন কে খুঁজতে খুঁজতে পাগলের মত হয়ে গেল মুক্তা।

১৫ দিন পর মুক্তার কাছে ফোন আসল। সুমনের ফোন। সুমন এখন ঢাকা আছে। ওই মেয়েটির সাথে বিয়ে হয়ে গেছে তার। পাসপোর্ট , ভিসা রেডি। ২/১ দিনের মধ্যে নতুন বউ নিয়ে ইতালি রওনা দিবে সুমন। সব শুনে মুক্তা পাথরের মত হয়ে গেল, তার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুচ্ছিল না। অনেক কষ্টে সুমনকে জিজ্ঞাসা করল, আমার পেটে যে তোমার সন্তান আছে, তার কি হবে? সুমন ছোট করে একটা হাসি দিয়ে বলল, দেখে রেখো। এই বলে সুমন ফোনটা কেটে দিল।  

----------------------------------------------------------------------------------------------------------

নিচের লেখাগুলোও আপনি পছন্দ করতে পারেন -

একটি সম্পূর্ণ প্রেমের গল্প

=চরিত্র - হনন=

সরকারী চাকুরীজীবী পাত্র



Post Comment

No comments:

Post a Comment