Sunday, March 29, 2020

= স্বপ্ন কথা =


স্বপ্ন এবার ৯ম শ্রেণিতে উঠেছে।
স্বপ্নকে নিয়ে তার মা বাবার অনেক স্বপ্ন। জন্মের আগেই তার মা বাবা তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন ভবিষ্যত ঠিক করে রেখেছেন। মায়ের স্বপ্ন ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে; অন্যদিকে বাবার স্বপ্ন ছেলে বড় হয়ে ব্যাংকার হবে। ছেলের জন্মের আগে মা বাবা বেশ কয়েকবার সমঝোতা সভায় বসেও সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেননি; পারেননি দু'জনের স্বপ্নকে এক করতে। তাই স্বপ্ন নাম নিয়ে মা বাবা দু'জনের ভিন্ন স্বপ্ন পূরণের দায় নিয়ে পৃথিবীর আলোর মুখ দেখে স্বপ্ন। জন্মের পরপরই ছেলের কান্না শুনে প্রশান্ত ব্যাথাতুর মা নার্সকে বলে উঠেছিলেন, দেখুন সিস্টার; কেমন ডাক্তারের মত কাঁদছে আমার সোনাচাঁন! অন্যদিকে প্রথম কোলে তুলে নিয়ে বাবা বললেন, কি ওয়ার্ল্ড ফেমাস ব্যাংকার; কেমন লাগছে এই পৃথিবী?

স্বপ্ন'র প্রথম শৈশব মা বাবার বাহুডোরেই কাটে। কিন্ডারগার্টেন এ ভর্তি হওয়ার পর কপালের ডানপাশে ইয়া বড় এক কালির ফোঁটা নিয়ে বিদ্যালয়ে যাওয়া আসা করতো স্বপ্ন। বহু বাকবিতন্ডা, যুক্তিতর্ক শেষে মা বাবা দু'জনে মিলে একটি পূর্ণাঙ্গ রুটিন তৈরি করলেন স্বপ্নের জন্য। অনেক ব্যাপারে দু'জনের বেশকিছু মতপার্থক্য থাকলেও দু'জন শতভাগ একমত হলেন, খেলাধুলা, গানবাজনা এইসব নিস্প্রয়োজনীয় ব্যাপার। তাই রুটিনে খেলাধুলা, গানবাজনা বা বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর জন্য কোন ঘর তৈরি হল না। বাসা থেকে স্কুল, স্কুল থেকে বাসা, দিনে সাতবার খাওয়াদাওয়া আর পড়া ও পড়া এবং পড়া; এসব উপকরণের সমাহারে তৈরি হল একটি রুটিন নামক উপাদেয় বস্তু! একবার বিদ্যালয়ের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তব্য পর্বে অংশগ্রহণ করে 'আমার জীবনের লক্ষ্য' শিরোনামে বক্তব্য প্রদান করতে গিয়ে জীবনের লক্ষ্য শিক্ষক হওয়া বলে ফেলায় ঝাড়ি শুনতে হয়েছে স্বপ্নকে। দ্বিপক্ষীয় আক্রমণের তোড়ে টিকতে না পেরে স্বপ্ন আশ্রয় নিয়েছিল পশ্চিম ঘরের আলমিরার কোণে। দুপুরে ভাতের বদলে মা বাবার মাথা চাপড়ানো হায় হায় বুলি আর  হা-হুতাশের ঘ্রাণে পেট ভরাতে হল তাকে। অধিক শোকে পাথর মা বাবা ভুলেই গেলেন দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে; উদর পূর্তির একটা দৈনন্দিন ক্রিয়া আছে। হাড়ির ভাত হাড়িতেই থাকল, মা বাবার অবিশ্রান্ত শব্দ-বোমা তাকে অসহায় করে তুললো।

জেএসসি পরীক্ষায় স্বপ্ন মা বাবার মুখ রক্ষা করেছে; গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। মা বাবা সন্তুষ্ট হলেন বটে, তবে কিছু একটা অপূর্ণতা কাজ করছিল তাঁদের মাঝে। ওদের স্কুল থেকে পনের জন শিক্ষার্থী গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে, স্বপ্ন ওই পনের জনের মধ্যে একজন; ব্যাপারটা একটু খোঁচাচ্ছিল স্বপ্ন'র মা বাবাকে৷ দু'জনে মনে মনে ভাবছিলেন গোল্ডেন এ প্লাস এর পাশাপাশি 'ডবল গোল্ডেন এ প্লাস' সিস্টেম চালু করা উচিত। তাহলে স্বপ্ন'র তথা স্বপ্ন'র মা বাবার এতো কষ্টের যথাযথ মূল্যায়ন হত কারণ তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন ডবল এ প্লাস সিস্টেম চালু করলে শুধুমাত্র ওই স্কুল নয় হয়তো সমগ্র বাংলাদেশ থেকে একমাত্র ডবল এ প্লাস অর্জন করতো স্বপ্ন। স্বপ্ন'র মা বাবা আসলে তার জেএসসি পরীক্ষার আগে যে পরিমাণ পরিশ্রম করেছেন তা উল্লেখযোগ্য। প্রতিদিন ভোর বেলা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মা স্বপ্নকে নিয়ে দৌড়েছেন এ স্যার থেকে সে স্যার, এ কোচিং সেন্টার থেকে সে কোচিং সেন্টারে, আবার সন্ধ্যা থেকে রাত বারটা পর্যন্ত একনাগাড়ে বসে থাকতেন স্বপ্ন'র পড়ার টেবিলের পাশে। স্বপ্ন তার এই কচি বয়সে যদি ১৩০% পরিশ্রম করে; তার মা করেছেন ২৬০ ভাগ পরিশ্রম। প্রায় ছয় মাসের জন্য স্বপ্ন'র ছোট খালাকে বাসায় এনে রাখা হয় রান্নাবান্না ও গৃহস্থালির অন্যান্য কাজগুলো সামাল দেওয়ার জন্য। ওদিকে স্বপ্ন'র বাবাও বসে ছিলেন না। ব্যাংকে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকার জোগাড় রাখলেন, প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে কিনা বা ফাঁস হলে কোথায় পাওয়া যেতে পারে; সে ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখছিলেন। তাছাড়া যে কেন্দ্রে স্বপ্ন পরীক্ষা দেবে, সে কেন্দ্রে কোন টিচার'রা দায়িত্বে থাকবেন; তাদের সাথে কিভাবে কন্টাক্ট ও কন্ট্রাক্ট করা যায় ইত্যাদি নিয়ে স্বপ্ন'র বাবা ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। এ যেন এক লঙ্কাকান্ড; যেন এক মহারণের ব্যাপক প্রস্তুতি। যদিও সেবার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটেনি তবে স্বপ্ন'র বাবা দু'জন টিচারের সাথে কন্টাক্ট করে কন্ট্রাক্ট করতে সক্ষম হয়েছিলেন। টিচারদ্বয় গ্যারান্টি সহকারে চুক্তিপত্র সম্পাদন করলেন এবং গৃহীত সম্মানির হালালকরণ নিশ্চিত করলেন। বলুন, এতো আয়োজনের পর ডবল গোল্ডেন এ প্লাস প্রত্যাশা করা কি বাড়াবাড়ি?!

স্বপ্নদের পরিবারে আজ দূর্যোগের ঘনঘটা। মা বাবার দ্বিখন্ডিত স্বপ্ন আজ প্রকাশ্য সংঘাতের রূপ নিয়েছে। কোন বিভাগে ভর্তি হবে স্বপ্ন? কার মনের স্বপ্ন পূরণ করবে সে? মায়ের স্বপ্ন পূরণ করে ডাক্তার হতে সে কি বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হবে? নাকি বাবার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে সে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হবে? নাকি বন্ধুবান্ধব, সামাজিকতা বিহীন বেড়ে উঠা স্বপ্ন'র সকল স্বপ্ন হারিয়ে যাবে কোন এক অন্ধকারের অতল গহ্বরে?

Post Comment

No comments:

Post a Comment