প্রতিদিন গড়ে প্রায় তেইশ ঘন্টাই গৃহবন্দী জীবন কাটাচ্ছি। আমার আবাসস্থলটি মীরসরাই উপজেলা সদরে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবস্থান করার কারণে ছয়তলার উপরে ছাদে উঠা যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি আশেপাশে খোলা মাঠের অপ্রতুলতার কারণে খোলা মাঠে মুক্ত আকাশের নিচে বসে সময় কাটানোর সম্ভাবনাও দিবাস্বপ্ন। তাই 'পারফেক্টলি হোম কোয়ারেন্টাইনে' আছি, এমনই বলা যায়। আর প্রতিদিন বিভিন্ন প্রয়োজনে ঘন্টাখানেক বাসার বাইরে থাকা হয়। এটি কোনভাবেই স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ দিনের তেইশ ঘন্টা ঘরের ভেতর কাটানোর কথা নয়। এভাবে মানব সন্তান টিকতে পারে না৷ তবে প্রকৃতি আমাদের কিছু অদ্ভুত শক্তি দিয়েছে। এরমধ্যে একটা হলো- খাপ খাইয়ে নেওয়ার শক্তি। জীবনের প্রয়োজনে মানুষ যেকোনো ভাবে যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। পল্লী মায়ের দামাল ছেলেটিও একদিন ইট-কাঠ-পাথরের শহরে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে; মায়ের মুখ না দেখে ঘুমোতে যেতে না পারা মেয়েটিও একদিন স্বামীর অপেক্ষায় রাত্রি জাগে; মুরগী জবাই করার ভয়ে পালিয়ে যাওয়া ছেলেটিও একদিন সদরঘাটের দুর্ধর্ষ মাস্তান হয়। মানুষ ছাড়া অন্যকোন প্রাণীকে প্রকৃতি খাপ খাইয়ে নেওয়ার এত শক্তি দিয়েছেন কিনা তা আমার জানা নেই।
আমিও খাপ খাইয়ে নিয়েছি। প্রথম কয়েকদিন খুব অসহ্য মনে হলেও এখন অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। অতিরিক্ত মাত্রায় ফেসবুকিং করি, গান গাই, গান শুনি, টিভি দেখি, ইউটিউবে মোশাররফ করিমের নাটক দেখে হাসি, বাচ্চাকে নিয়ে পড়তে বসি, কিছুকিছু লেখালেখি করার চেষ্টা করি। তাছাড়া, প্রকৃতির সংস্পর্শ পাওয়ার জন্য বাসায় দুটো জায়গা তৈরি করে নিয়েছি। একটি শোবার ঘরের ব্যালকনি, যেখানে একটা চেয়ার পেতে দিয়েছি; আরেকটি বসার ঘরের পাশের বড় জানালা, যেখানে একটি সোফা পেতে দিয়েছি। যখনই প্রকৃতির সংস্পর্শ পেতে ইচ্ছে করে, তখনই যেকোন একটি স্থান বেছে নেই। চেয়ারে বা সোফায় বসে পাখির কিচিরমিচির শুনি, বৈশাখী বাতাসে উন্মাতাল আম্রপল্লব দেখি, সবুজের সমারোহ উপভোগ করি, সময়ে সময়ে বৃষ্টির গান শুনি, 'মনা' কিংবা 'মিন্টু-দা' কে হেঁটে যেতে দেখি, আম গাছ হতে কাঁচা আম পাড়ার দৃশ্য উপভোগ করি। ভালোই কেটে যাচ্ছে। মনে হতে শুরু হয়েছে, এটাই জীবন।
সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও এখন করোনা-কাল পার করছে। পুরো পৃথিবীকে মূলতঃ এই ছোট্ট ভাইরাস কোনঠাসা করে ফেলেছে। চীনে এ ভাইরাস প্রথম আক্রমণ করার কারণে অনেকে চীনের দিকে বাঁকা চোখে তাকালেও পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ না থাকায় চীন এখনো বড়সড় একটা আক্রমণ থেকে বেঁচে আছে। ভবিষ্যতে কি হবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। 'বিশ্ব পান্ডা' ট্রাম্প ইতিমধ্যে কৌশলে চীনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শব্দ বোমা নিক্ষেপ করে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতি ট্রাম্প নাখোশ হওয়ার কারণে মার্কিন অর্থ সহায়তা থেকে ইতিমধ্যে বঞ্চিত হয়েছে সংস্থাটি।
আমি শিক্ষক মানুষ। সাদাসিধা জীবন আমার৷ সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস। এরপর প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্ম সেরে নিজের কর্মস্থলে গিয়ে বিকেল চারটা পর্যন্ত কাটিয়ে বাসায় ফিরে আসা। কোন প্রাইভেট, টিউশন বা কোচিংয়ের সাথে আমি জড়িত নই। সন্ধ্যায় ঘন্টা তিনেক সমমনাদের সাথে আড্ডায় কাটিয়ে বাসায় ফিরে পরবর্তী দিনের শ্রেণি প্রস্তুতি গ্রহণ। বাকি সময়টা পারিবারের সঙ্গে কাটানো। এভাবেই বেশ কেটে যাচ্ছিল। করোনা-কাল অতিক্রান্ত হলে আবার এটাই হবে আমার স্বাভাবিক জীবনযাপন। যদিও জীবনের প্রয়োজনে পরিবর্তিত জীবনপ্রবাহের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছি, তবু খুব বেশি শূন্যতা অনুভব করি শ্রেণিকক্ষের কথা মনে করে। আমার পেশাগত জীবনে আমি শ্রেণিকক্ষটাকেই সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি। শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলি, তাদের কিছু জানানোর চেষ্টা করি, তাদের কাছ থেকে জানি, কখনো হাসি, কখনো কঠোরতা অবলম্বন করি। প্রচন্ড একটা তৃপ্তি অনুভব করি শ্রেণি কক্ষের কার্যক্রমে। কর্মস্থলে সত্যিকার অর্থে আর কিছু তেমন উপভোগ করি না। প্রিয় মাতৃভূমির প্রতিটি খাতের মতো পবিত্র শিক্ষাখাতও আজ দূর্ণীতি, স্বজনপ্রীতি ও অদক্ষতার করালগ্রাসে জর্জরিত। অন্যায় করা ও অন্যায় সহ্য করার প্রবণতার পাশাপাশি আত্মঅহমিকা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও অদক্ষতা বর্তমান সময়ের তথাকথিত মানুষ গড়ার কারিগরদের জাতীয় ব্যাধি বা বোঝায় পরিণত করছে। তাই শ্রেণিকক্ষ ব্যাতিত কর্মস্থলে আর কিছু উপভোগ করার মতো পরিবেশ নেই।
এই করোনা-কালে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের সহায়তায় অনেকের এগিয়ে আসা। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কর্মহীন ও উপার্জনহীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার, জনপ্রতিনিধি, প্রায় সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ছাত্রনেতা, যুবনেতাসহ অনেকে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ। বিশেষ করে আমাদের মীরসরাইতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ হয়েছে বলে আমার ধারণা। তবে সমন্বয়হীনতার কারণে কারো কারো একাধিকবার ত্রাণ পাওয়া আর কারো একেবারেই না পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে শোনা যায়। এতবড়ো কর্মযজ্ঞে বাংলাদেশের মতো আবেগ প্রধান একটা দেশে সমন্বয় সাধন করা সত্যিই দুঃসাধ্য। তারপরও সকল বেসরকারি ত্রাণ যদি উপজেলা প্রশাসনের মধ্যমে বিতরণ করা সম্ভব হতো,তাহলে হয়তো আমাদের গায়ে এ সামান্য কালিও লেপন হতো না।
বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছেন আমাদের এই দূর্যোগ থেকে মুক্তি দিতে। কোন কোন চিকিৎসা বিজ্ঞানী ভ্যাক্সিন নিয়ে কাজ করছেন, আর কেউবা এই ভাইরাস বিধ্বংসী গোলা-বারুদ অর্থাৎ ঔষধ আবিষ্কারে মরিয়া হয়ে কাজ করছেন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এখনো কোন সুখের খবর পাওয়া যায় নি। বাংলাদেশেও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ডাক্তার, নার্স, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা 'ফ্রন্ট লাইন সোলজার' হিসেবে জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে একজন ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার ঘটনা ঘটেছে; তাছাড়া অনেক ডাক্তার, নার্স ও পুলিশ বাহিনীর বেশকিছু সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে শোনা গেছে। ইতিহাসের পাতায় নিশ্চয় উনাদের অবদানের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর ইমেজ গঠনে এই কর্মকাণ্ড বিশেষ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে নিঃসন্দেহে বলা যায়।
সুইডেন, ব্রাজিল, সার্বিয়া করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভিন্ন পথে হাঁটছে। তারা এখনো লকডাউন করেনি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ইতিমধ্যে লক ডাউন থেকে সরে আসার ইংগিত দিয়েছে। নিউজিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট লকডাউন ঘোষণা করায় তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধনের অভিযোগ এনে ওই দেশের আদালতে মামলা করেছে দু'জন নাগরিক। বাংলাদেশে অঘোষিত লকডাউনের আজ ত্রিশ দিন অতিক্রান্ত হচ্ছে। এতোদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে, অর্থাৎ ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। আমার মতে, এখন শরীরকে নিজের সুরক্ষা নিজেকেই নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত।
সর্বোপরি, অল্পদিন পরেই, যখন খাদ্যাভাব প্রকট হবে, তখন মানুষকে চাইলেও আর ঘরে আটকে রাখা যাবে না। আমার কেন যেন মনে হয়, লকডাউন করে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে আসলে কিছুই করা যায় না, কারণ মানুষ তার জীবনের প্রয়োজনে কারো না কারো কন্টাক্টে যাবেই, শুধু একবারের স্পর্শ, একটা মাইক্রো ড্রপলেটই এই ভাইরাস সংক্রমণের জন্য যথেষ্ট। তাই লকডাউন দিয়ে একে আটকে রাখার কোন উপায় নেই৷ যতই লকডাউন হোক, বাঁচার প্রয়োজনে একজন মানুষকে কারো না কারো কন্টাক্টে যেতেই হচ্ছে। ইটালি, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে।
হয়তো অল্পদিনেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে, হয়তোবা অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘ সময়। মানব জাতি বরাবরের মতো মাথা তুলে দাঁড়াবেই। তবে মাথা তুলে দাঁড়ানো মানে তো স্বেচ্ছাচারীতা হতে পারে না। আমরা বিপদগ্রস্ত হলে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করি, ধর্মীয় রীতিনীতি মেলে চলি, সৎ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনাচরণে অভ্যস্ত হই, পরকালের চিন্তায় সকল পাপ কাজ হতে বিরত থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু বিপদ কেটে গেলেই আমরা চরমভাবে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠি- সৃষ্টিকর্তা, ধর্মীয় রীতিনীতি ভুলে গিয়ে বিশৃঙ্খল জীবনাচরণে অভ্যস্ত হই, পরকালের চিন্তা বাদ দিয়ে দূর্নীতি, নৈরাজ্য, অরাজকতা, পরিবেশ দূষন, বৃক্ষ নিধন সহ বিভিন্ন আসুরিক পাপ কাজে লিপ্ত হই। এবার হয়তো আর ছাড় নেই। অঙ্গীকার আদায় করেই হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই আজাব থেকে মুক্তি দিবেন।
এপ্রিল ২৪, ২০২০
আমিও খাপ খাইয়ে নিয়েছি। প্রথম কয়েকদিন খুব অসহ্য মনে হলেও এখন অনেকটাই সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। অতিরিক্ত মাত্রায় ফেসবুকিং করি, গান গাই, গান শুনি, টিভি দেখি, ইউটিউবে মোশাররফ করিমের নাটক দেখে হাসি, বাচ্চাকে নিয়ে পড়তে বসি, কিছুকিছু লেখালেখি করার চেষ্টা করি। তাছাড়া, প্রকৃতির সংস্পর্শ পাওয়ার জন্য বাসায় দুটো জায়গা তৈরি করে নিয়েছি। একটি শোবার ঘরের ব্যালকনি, যেখানে একটা চেয়ার পেতে দিয়েছি; আরেকটি বসার ঘরের পাশের বড় জানালা, যেখানে একটি সোফা পেতে দিয়েছি। যখনই প্রকৃতির সংস্পর্শ পেতে ইচ্ছে করে, তখনই যেকোন একটি স্থান বেছে নেই। চেয়ারে বা সোফায় বসে পাখির কিচিরমিচির শুনি, বৈশাখী বাতাসে উন্মাতাল আম্রপল্লব দেখি, সবুজের সমারোহ উপভোগ করি, সময়ে সময়ে বৃষ্টির গান শুনি, 'মনা' কিংবা 'মিন্টু-দা' কে হেঁটে যেতে দেখি, আম গাছ হতে কাঁচা আম পাড়ার দৃশ্য উপভোগ করি। ভালোই কেটে যাচ্ছে। মনে হতে শুরু হয়েছে, এটাই জীবন।
সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশও এখন করোনা-কাল পার করছে। পুরো পৃথিবীকে মূলতঃ এই ছোট্ট ভাইরাস কোনঠাসা করে ফেলেছে। চীনে এ ভাইরাস প্রথম আক্রমণ করার কারণে অনেকে চীনের দিকে বাঁকা চোখে তাকালেও পর্যাপ্ত তথ্য প্রমাণ না থাকায় চীন এখনো বড়সড় একটা আক্রমণ থেকে বেঁচে আছে। ভবিষ্যতে কি হবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। 'বিশ্ব পান্ডা' ট্রাম্প ইতিমধ্যে কৌশলে চীনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শব্দ বোমা নিক্ষেপ করে যাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতি ট্রাম্প নাখোশ হওয়ার কারণে মার্কিন অর্থ সহায়তা থেকে ইতিমধ্যে বঞ্চিত হয়েছে সংস্থাটি।
আমি শিক্ষক মানুষ। সাদাসিধা জীবন আমার৷ সকালে একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস। এরপর প্রাত্যহিক ক্রিয়াকর্ম সেরে নিজের কর্মস্থলে গিয়ে বিকেল চারটা পর্যন্ত কাটিয়ে বাসায় ফিরে আসা। কোন প্রাইভেট, টিউশন বা কোচিংয়ের সাথে আমি জড়িত নই। সন্ধ্যায় ঘন্টা তিনেক সমমনাদের সাথে আড্ডায় কাটিয়ে বাসায় ফিরে পরবর্তী দিনের শ্রেণি প্রস্তুতি গ্রহণ। বাকি সময়টা পারিবারের সঙ্গে কাটানো। এভাবেই বেশ কেটে যাচ্ছিল। করোনা-কাল অতিক্রান্ত হলে আবার এটাই হবে আমার স্বাভাবিক জীবনযাপন। যদিও জীবনের প্রয়োজনে পরিবর্তিত জীবনপ্রবাহের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছি, তবু খুব বেশি শূন্যতা অনুভব করি শ্রেণিকক্ষের কথা মনে করে। আমার পেশাগত জীবনে আমি শ্রেণিকক্ষটাকেই সবচেয়ে বেশি উপভোগ করি। শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলি, তাদের কিছু জানানোর চেষ্টা করি, তাদের কাছ থেকে জানি, কখনো হাসি, কখনো কঠোরতা অবলম্বন করি। প্রচন্ড একটা তৃপ্তি অনুভব করি শ্রেণি কক্ষের কার্যক্রমে। কর্মস্থলে সত্যিকার অর্থে আর কিছু তেমন উপভোগ করি না। প্রিয় মাতৃভূমির প্রতিটি খাতের মতো পবিত্র শিক্ষাখাতও আজ দূর্ণীতি, স্বজনপ্রীতি ও অদক্ষতার করালগ্রাসে জর্জরিত। অন্যায় করা ও অন্যায় সহ্য করার প্রবণতার পাশাপাশি আত্মঅহমিকা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও অদক্ষতা বর্তমান সময়ের তথাকথিত মানুষ গড়ার কারিগরদের জাতীয় ব্যাধি বা বোঝায় পরিণত করছে। তাই শ্রেণিকক্ষ ব্যাতিত কর্মস্থলে আর কিছু উপভোগ করার মতো পরিবেশ নেই।
এই করোনা-কালে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের সহায়তায় অনেকের এগিয়ে আসা। উদ্ভুত পরিস্থিতিতে কর্মহীন ও উপার্জনহীন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সরকার, জনপ্রতিনিধি, প্রায় সকল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ছাত্রনেতা, যুবনেতাসহ অনেকে প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিবর্গ। বিশেষ করে আমাদের মীরসরাইতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ হয়েছে বলে আমার ধারণা। তবে সমন্বয়হীনতার কারণে কারো কারো একাধিকবার ত্রাণ পাওয়া আর কারো একেবারেই না পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে বলে শোনা যায়। এতবড়ো কর্মযজ্ঞে বাংলাদেশের মতো আবেগ প্রধান একটা দেশে সমন্বয় সাধন করা সত্যিই দুঃসাধ্য। তারপরও সকল বেসরকারি ত্রাণ যদি উপজেলা প্রশাসনের মধ্যমে বিতরণ করা সম্ভব হতো,তাহলে হয়তো আমাদের গায়ে এ সামান্য কালিও লেপন হতো না।
বিশ্ব বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা প্রাণপন চেষ্টা করে যাচ্ছেন আমাদের এই দূর্যোগ থেকে মুক্তি দিতে। কোন কোন চিকিৎসা বিজ্ঞানী ভ্যাক্সিন নিয়ে কাজ করছেন, আর কেউবা এই ভাইরাস বিধ্বংসী গোলা-বারুদ অর্থাৎ ঔষধ আবিষ্কারে মরিয়া হয়ে কাজ করছেন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এখনো কোন সুখের খবর পাওয়া যায় নি। বাংলাদেশেও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ডাক্তার, নার্স, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা 'ফ্রন্ট লাইন সোলজার' হিসেবে জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছেন। ইতিমধ্যে একজন ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার ঘটনা ঘটেছে; তাছাড়া অনেক ডাক্তার, নার্স ও পুলিশ বাহিনীর বেশকিছু সদস্য করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে শোনা গেছে। ইতিহাসের পাতায় নিশ্চয় উনাদের অবদানের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর ইমেজ গঠনে এই কর্মকাণ্ড বিশেষ ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে নিঃসন্দেহে বলা যায়।
সুইডেন, ব্রাজিল, সার্বিয়া করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভিন্ন পথে হাঁটছে। তারা এখনো লকডাউন করেনি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ইতিমধ্যে লক ডাউন থেকে সরে আসার ইংগিত দিয়েছে। নিউজিল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট লকডাউন ঘোষণা করায় তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধনের অভিযোগ এনে ওই দেশের আদালতে মামলা করেছে দু'জন নাগরিক। বাংলাদেশে অঘোষিত লকডাউনের আজ ত্রিশ দিন অতিক্রান্ত হচ্ছে। এতোদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে, অর্থাৎ ভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। আমার মতে, এখন শরীরকে নিজের সুরক্ষা নিজেকেই নেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত।
সর্বোপরি, অল্পদিন পরেই, যখন খাদ্যাভাব প্রকট হবে, তখন মানুষকে চাইলেও আর ঘরে আটকে রাখা যাবে না। আমার কেন যেন মনে হয়, লকডাউন করে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে আসলে কিছুই করা যায় না, কারণ মানুষ তার জীবনের প্রয়োজনে কারো না কারো কন্টাক্টে যাবেই, শুধু একবারের স্পর্শ, একটা মাইক্রো ড্রপলেটই এই ভাইরাস সংক্রমণের জন্য যথেষ্ট। তাই লকডাউন দিয়ে একে আটকে রাখার কোন উপায় নেই৷ যতই লকডাউন হোক, বাঁচার প্রয়োজনে একজন মানুষকে কারো না কারো কন্টাক্টে যেতেই হচ্ছে। ইটালি, যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন এক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে।
হয়তো অল্পদিনেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে, হয়তোবা অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘ সময়। মানব জাতি বরাবরের মতো মাথা তুলে দাঁড়াবেই। তবে মাথা তুলে দাঁড়ানো মানে তো স্বেচ্ছাচারীতা হতে পারে না। আমরা বিপদগ্রস্ত হলে সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করি, ধর্মীয় রীতিনীতি মেলে চলি, সৎ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনাচরণে অভ্যস্ত হই, পরকালের চিন্তায় সকল পাপ কাজ হতে বিরত থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু বিপদ কেটে গেলেই আমরা চরমভাবে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠি- সৃষ্টিকর্তা, ধর্মীয় রীতিনীতি ভুলে গিয়ে বিশৃঙ্খল জীবনাচরণে অভ্যস্ত হই, পরকালের চিন্তা বাদ দিয়ে দূর্নীতি, নৈরাজ্য, অরাজকতা, পরিবেশ দূষন, বৃক্ষ নিধন সহ বিভিন্ন আসুরিক পাপ কাজে লিপ্ত হই। এবার হয়তো আর ছাড় নেই। অঙ্গীকার আদায় করেই হয়তো সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই আজাব থেকে মুক্তি দিবেন।
এপ্রিল ২৪, ২০২০
No comments:
Post a Comment