Monday, February 16, 2015

পিতার কান্না

চৈতালি রায় অত্র এলাকার একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ত ছিলেন। ছিলেন বলছি এই কারনে, তিনি বর্তমানে আর এই পৃথিবীতে নেই। প্রায় এক যুগ আগে মরনব্যাধি ক্যান্সার তাঁর জীবন কেড়ে নিয়েছে। এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ত্রিশ বছর। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্বামী বরুন বাবু হয়েছেন পত্নীহীন আর তাঁর ছেলে অপু আর মেয়ে মনি হয়েছে মাতৃহীন। তাঁর মৃত্যুকালে অপুর বয়স ছিল সাত বছর আর মনির বয়স ছিল মাত্র চার বছর।

চৈতালি রায় ছিলেন একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ভাল গান গাইতেন। খুব সহজে মানুষের সাথে মিশে যেতে পারতেন। অত্র এলাকার সকল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে তাঁর ছিল উচ্ছল ও প্রাণবন্ত বিচরন। সকলেই তাঁকে ভালবাসতেন। হয়তো সৃষ্টিকর্তাও তাঁকে বেশি ভালবাসতেন, তাই অতি দ্রুতই চৈতালি রায়কে ফিরে যেতে হয় সৃষ্টিকর্তার কাছে।

চৈতালি রায় এর মৃত্যুর পর সত্যিকার অর্থে বরুন বাবুর পরিবারটা এলোমেলো হয়ে যায়। তখন বরুন বাবু একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পেশাগত দায়িত্ব পালন এর পাশাপাশি ছেলে-মেয়ের যত্ন নেয়া, সংসার সামলানো - - - - - - - বরুন বাবু হাঁপিয়ে উঠছিলেন। আত্মীয় স্বজনরাও বিষয় টা বুঝতে পারছিলেন। ধীরে ধীরে আত্মীয় স্বজনরা বরুন বাবুর সংসারটা আবার নতুন করে গড়ার বিষয়ে আলাপ আলোচনা করা শুরু করলেন। বছরখানেক যাওয়ার পর আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে বর্ষীয়ান সকলেই একমত হলেন যে, এভাবে আর চলতে পারে না, এবার কিছু একটা না করলেই নয়। বরুন বাবুর কাকা বিষয়টা বরুন বাবুর কাছে উপস্থাপন করলেন। বললেন, "ছেলে মেয়ে গুলোর দিকে একটু তাকাও, এটাকে কি সংসার বলা চলে? আর তোমার শরীরের কি অবস্থা হয়েছে, দেখেছ? যে চলে যাবার সে চলে গেছে। তোমাদের এই বেহাল দশা দেখে সেওতো কষ্ট পাচ্ছে। এবার দেখে শুনে একটা মেয়ে নিয়ে এসো। ছেলে মেয়েগুলো অন্তত মা বলে কাউকে ডাকুক। তারাও একটু শান্তি পাক। আমরাও একটু শান্তি পাই।" বরুন বাবুর গম্ভীর মুখ হতে কোন প্রতিউত্তর না পেয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করে একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে কাকাবাবু ওই ঘর ত্যাগ করলেন।

কাকাবাবুর প্রস্তাব টা পাওয়ার পর বরুন বাবু ভাবতে লাগলেন। কিভাবে সম্ভব? চৈতালি তার সমগ্র স্বত্বাজুড়ে। কিভাবে তিনি চৈতালির জায়গায় অন্য কাউকে স্থান দিবেন। এসব ভাবতে ভাবতে বারবার তিনি শুধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিলেন। এভাবে প্রায় আরও মাস ছয়েক কেটে গেল। আত্মীয় স্বজনের চাপ বাড়তে লাগল। অবশেষে তিনি কাবু হলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, আবার বিয়ে করবেন। তবে এক শর্তে। নতুন সংসারে তিনি কোন সন্তান নিবেন না। তাই আত্মীয় স্বজনদের বলে দিলেন- হয়তো কোন বিধবা নয়তো সন্তান উৎপাদনে অক্ষম কোন মহিলার খোঁজ করার জন্য। আত্মীয় স্বজনরাও বিষয়টাকে ইতিবাচক হিসেবে নিলেন। ছেলে মেয়ের মধ্যে অপুই একটু বুঝতে শিখেছে, তাই তার সাথেই বিষয়টা নিয়ে পারিবারিক আলোচনা সারালেন বরুন বাবু। অবশেষে সন্তান উৎপাদনে অক্ষম কল্পনা রাণীর সাথে পুনঃবিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন বরুন বাবু। 



নতুন বউ আর ছেলে মেয়ে নিয়ে সময়গুলো ভালই কেটে যাচ্ছিল বরুন বাবুর। কল্পনা রাণী মায়ের স্নেহ মমতা দিয়ে অপু আর মনিকে আপন করে নিলেন। তারাও খুশি, বিশেষ করে মনি। নতুন মাকে পেয়ে মনির আনন্দ যেন বাধা মানছিলনা। বরুন বাবু তৃপ্তি অনুভব করছিলেন। এককথায়, চৈতালি রায় এর স্মৃতি আর কল্পনা রাণীর ভালবাসা বরুন বাবুর সংসার বাগানকে আবার নতুন করে ফুলে গন্ধে ভরে দিল। 

কথায় আছে, দুঃখের পরে সুখ আসে। তাহলে সুখের পরও দুঃখ আসবে, এটাইতো স্বাভাবিক। বরুন বাবুর সুখ বেশি দিন স্থায়ী হল না। জীবন আকাশে আবার কাল মেঘ উঁকি দিতে লাগল। 

অপু এবার এস এস সি পরীক্ষা দিবে।  ইদানিং তার চলাফেরার ধরন কল্পনা রাণীর কাছে ভাল ঠেকছে না। স্কুল শেষ করে সাথে সাথে বাড়ি ফিরে আসে না। রাত করে বাড়ি ফিরে। বন্ধু বান্ধব এর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। অনেক রাত পর্যন্ত যদিও পড়ার টেবিলে বসে থাকে কিন্তু পড়ায় মন আছে বলে মনে হয় না। কল্পনা রানীকে আগের মত বড় গলায় ইদানিং অপু মা বলে ডাকে না। বাসার অন্যদের সাথেও  অনেক কম কথা বলে। মনি আবদার নিয়ে কিছু বলতে গেলে অপু ক্ষেপে যায়। কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে ছেলেটা! কল্পনা রাণী সব লক্ষ্য করছিলেন। বরুন বাবু চাকুরী, সাংসারিক ও সামাজিক কাজ ইত্যাদি নিয়ে স্বাভাবিক ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিলেন। তাছাড়া ছেলে মেয়ের দায়িত্ব টা তিনি কল্পনা রাণীর উপরই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাই ছেলের এই পরিবর্তনটা তেমন একটা তাঁর চোখে পড়েনি। কল্পনা রাণী একবার ভাবলেন বিষয়টা নিয়ে স্বামীর সাথে আলাপ করবেন। আবার ভাবলেন, দেখা যাক, উঠতি বয়সী ছেলে, হয়তো বিষয়টা স্বাভাবিক, কয়েকদিন পরেই হয়তো ঠিক হয়ে যাবে, জানলে উনি শুধু শুধু টেনশান করবেন ইত্যাদি ভেবে কল্পনা রাণী বিষয়টা আর বরুন বাবুকে না জানিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলেন। মাস খানেক পার হয়ে গেল। কোন উন্নতি তো হলই না, বরং দিন দিন অপু আরও বেপরোয়া হয়ে উঠতে লাগল। একদিন সন্ধ্যার পর কল্পনা রাণী অপুর টেবিলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। অপুর মাথায় হাত রাখলেন। অপু ধ্যান ভঙ্গের মত চোখ তুলে কল্পনা রানীকে দেখে মুখে একটা বিরক্তির ভাব প্রকাশ করল। কল্পনা রাণী বললেন, বাবা তুই এমন হয়ে যাচ্ছিস কেন? কি হয়েছে তোর? কোন সমস্যা থাকলে --------------- আর বলতে পারলেন না। একরাশ বিরক্তির ভাব নিয়ে মাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অপু উত্তর দিল, কিছু হয় নি আমার। কি হবে? এরপর একটু নিচু কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, আপনি কি বুঝবেন? আপনি তো আমার মা না। আমার মা থাকলে হয়তো তিনি আমার মনের দুঃখ বুঝতেন। কল্পনা রাণীর বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। অপুর চোখের দিকে তিনি আর তাকিয়ে থাকতে পারলেন না। বুকটা খা খা করছে। মাটির দিকে তাকিয়ে তিনি সেই ঘর ত্যাগ করলেন। 

বরুন বাবুর কপালে চিন্তার রেখা স্পষ্ট হল। নদীর পাড় ভাঙ্গা শব্দ তাঁর কানে বাজতে লাগলো। ভাবতে লাগলেন। ভাবতে লাগলেন, কিভাবে অপুর সাথে কথা বলা যায়। সন্ধ্যার পর অপুর ঘরে ঢুকে খাটের উপর বসলেন। পড়ালেখার খোঁজ খবর নেয়ার মাধ্যমে কথা বলা শুরু করলেন। আজ অপুকে বরুন বাবুর কাছে অনেক অচেনা লাগছে। কথাবার্তায় কেমন যেন গোঁয়ারতুমি ভাব প্রকাশ পাচ্ছে। কোন কিছুরই সোজা উত্তর সে তার বাবাকে দিচ্ছে না। প্রায় পনের মিনিট কথাবার্তা বলে অতৃপ্ত মন নিয়ে বরুন বাবু ওই ঘর ত্যাগ করলেন। নিজের খাটের উপর নির্বাক হয়ে বসে রইলেন। পাশে এসে বসলেন কল্পনা রাণী। বরুন বাবু মনে মনে নিজেকে দোষী ভাবতে লাগলেন। তিনি কি আসলেই ভুল করেছেন? ছেলেটা এমন হয়ে গেছে কেন? আবার ভাবতে লাগলেন, কল্পনাতো কখনো অপু-মনির সাথে সৎ মায়ের মত আচরন করেনি, তাহলে কেন ছেলেটা এমন করছে? 

অপুর এস এস সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। অপু পিসির বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে। বরুন বাবু ফোন করে তার বোনকে বলে দিলেন অপুর দিকে একটু লক্ষ্য রাখতে। বোন নিশ্চিত করলেন, কোন সমস্যা হবে না। বললেন, মিঠু'র সাথে অপুর সময় খুব ভালভাবেই কেটে যাবে। মিঠু বরুন বাবু'র ছোট বোনের ছেলে। অপুর প্রায় সমবয়সী। লিখাপড়া আনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। এখন গঞ্জে পানের দোকান করে। 

মিঠুর সাথে অপুর সময়গুলো বেশ ভালই কেটে যাচ্ছিল। বাড়িতে থাকতে অপু ঘরে ফিরত রাত আট'টার দিকে, এখন মিঠুর সাথে ঘরে ফিরে রাত দশটা এগারোটার দিকে। বাড়িতে থাকতে অপু রাতে ঘরে ফিরে চুপ করে টেবিলে বসে থেকে খেয়ে দেয়ে ঘুমাত, এখন ঘরে ফিরে অপু মিঠুর মোবাইল থেকে অনেক অচেনা বান্ধবীদের সাথে অনেকক্ষণ আমেজী কথা বলে তারপর ঘুমায়। বাড়িতে থাকতে অপু লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু সিগারেট এ সুখটান দিত, এখন মিঠুর সাথে অপু মাঝেমধ্যেই নিষিদ্ধ কাশির ওষুধ দিয়ে গলা ভেজায়। 

বেশ কয়েক মাস কেটে গেল। এস এস সি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার দিন ঘনিয়ে এলো। বরুন বাবু তাঁর ছোট বোনের কাছে ফোন করলেন। বললেন, এবার অপুকে বাড়ি আসতে বল। পরীক্ষার ফলাফল দিবে। এখনো কি বেড়াবে? অপুর সাথে তিনি কথা বলতে চাইলেন কিন্তু অপু সম্মত হল না। এ কয় মাসের মধ্যে আরও কয়েকবার তিনি অপুর সাথে ফোন এ কথা বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু অপু সম্মত না হওয়ায় বরুন বাবুর আশা পূরন হয়নি। এমনকি পিসির মাধ্যমে অপু জানিয়ে দিয়েছে, তার বাবা মা যেন ওখানে না যায়। ফলে বরুন বাবু ও কল্পনা রাণী পুত্রহীন সময় কাটাচ্ছিলেন। অনেক কষ্ট অনুভব করছিলেন, তবুও মেনে নিচ্ছিলেন এই ভেবে যে, ঘুরাঘুরি করে ছেলের মাথাটা যদি একটু ঠিক হয়। 

ফলাফলের দিনও অপু বাড়ি এলোনা, এমনকি কোন খবরও নিল না। স্বাভাবিকভাবেই অপু পরীক্ষায় ফেল করলো। বরুন বাবু বোনের বাড়িতে গেলেন। অপু বাবার আগমনের বিষয়টি টের পেয়ে সরে পড়ল। পিতা পুত্রের দেখা হল না। বোনকে বরুন বাবু বারবার বললেন, তুই একটু বুঝিয়ে বলিস, আমার কথা তো শুনে না, আমিতো তার চোখে অপরাধী। চোখ মুছতে মুছতে বরুন বাবু বিদায় নিলেন। 

অপু এখন পুরোদস্তুর একজন পান দোকানদার। তবে দোকান নিজের নয়। পিসিদের দোকান। কর্মচারীই বলা যায়, তবে মুখ ফুটে হয়তো কেউ বলে না। বাড়ি থেকে সেই যে বের হয়েছে আর বাড়ি ফিরেনি। মা বাবার সাথে কোন যোগাযোগ নেই। মাঝখানে সাধ করে একটা বিয়েও করেছিল কিন্তু ৩ মাসের বেশি টিকেনি। 

ইতিমধ্যে বরুন বাবু ভাল ঘর দেখে মনি'র বিয়ে দিয়েছেন। অপু বিয়েতে আসেনি। বরুন-কল্পনা দম্পতি ধরেই নিয়েছেন তাদের কোন ছেলে নাই। কল্পনা রাণী এখনো একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজেন, কি ছিল তার অপরাধ? বরুন বাবু এখন নিজেকে মহাপাপী ভাবেন। সবকিছুর জন্য নিজেকেই দায়ী করেন আর আড়ালে বসে বসে কাঁদেন। 


Post Comment

No comments:

Post a Comment