গাছটা হঠাৎ করেই কথা বলা শুরু করলো। চৈত্র মাসের দুপুর বেলা, কড়া রৌদে চারদিক বাদামী রঙ ধারণ করেছে, পানির অভাবে ফাঁকা জমি গুলো হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। দুপুরের খাওয়া শেষ করে একটা স্টার ফিল্টার জ্বালিয়ে দ্বীপ স্নিগ্ধ বাতাসে শরীর ভেজানোর আশায় বটতলায় এসে দাঁড়িয়েছিল। মিনিট খানেক পরেই গাছটা কথা বলে উঠলো। দ্বীপ অবাক হলো; এতো হওয়ার কথা নয়। তার তেত্রিশ বছর বয়েসে কখনো তো সে কোন গাছকে কথা বলতে দেখেনি! তবে সে শুনেছে; বইপত্রে পড়েছে একসময় নাকি গাছরা কথা বলতো, কবিতা আবৃত্তি করতো, নেচে-গেয়ে মাতোয়ারা হতো, কথার ফুলঝুরি ফুটিয়ে অন্যকে বিমোহিত করার পাশাপাশি নিজের ভাবনার রাজ্যের পালে হাওয়া লাগাতো গাছরা। কিন্তু সে তো অনেক..... আগের কথা; প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। গাছরা কথা বলতে ভুলে গেছে, এটাই তো স্বাভাবিক! তাহলে আজ এমন কি হলো, এই বটবৃক্ষ কেন হঠাৎ কথা বলে উঠলো!
গাছটা বলে উঠলো, "তুমি আমার অধিকার খর্ব করছ।" অধিকার! ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে বট গাছটির দিকে তাকিয়ে রইলো দ্বীপ। এরপর হো হো করে উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো সে। হাসি সামলানোর চেষ্টা করতে করতে বললো, অধিকার শব্দটি এখনো তোমাদের অভিধানে আছে! আমাদের প্রজন্ম তোমাদের কথা বলতেই তো দেখেনি, বিলুপ্ত হতে হতে কোনরকম জড়বৎ তোমরা টিকে আছ এই ধরণীতে। আর সেই তোমরাই অর্থাৎ তুমিই নাকি আজ অধিকারের কথা বলছো! যখন তোমাদের হাত পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, তোমরা অধিকারের কথা বলেছিলে? যখন তোমাদের বইপত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, যখন তোমাদের আবৃত্তির ছন্দ ছেদ করা হয়েছিল, তোমরা অধিকারের কথা বলেছিলে? যখন তোমাদের কাঁধের উপর থেকে মাথাটা সরিয়ে নেওয়া হলো, যখন তোমাদের চোখ দুটো উপড়ে নেওয়া হলো, যখন অসুরীয় ভয়ংকর চিৎকারে তোমাদের শ্রবণশক্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত কোমড় ভেঙে যখন তোমাদের মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল; তখন তোমরা নিজেদের অধিকারের কথা বলেছিলে? আজ তুমি অধিকারের কথা বলছো, ধিক তোমার প্রতি। তোমরা নিজেদের কথা ভাবোনি; তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথাও ভাবোনি।
হঠাৎ দ্বীপের খেয়াল হলো, আচ্ছা গাছটা কথা বলছে কি করে! এর তো মুখই দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি ব্যবহারহীন থাকতে থাকতে গাছদের বাগযন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে গেছে? জ্বালানো স্টার ফিল্টারে শেষ টান দিতে দিতে দ্বীপ বললো, অনেক কথাই তো বললে এবার তোমার মুখটা একটু দেখাও, দেখে নিজেকে ধন্য করি। গাছ এবার আর কোন কথা বললো না, কোন উত্তরও দিলো না। যেমনি মুখ লুকিয়ে ছিল; তেমনি মুখ লুকিয়েই থাকলো। বটবৃক্ষেরা হয়তো এভাবেই মুখ লুকিয়ে থাকবে অনন্তকাল!
প্রবাল ভৌমিক, মীরসরাই, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ইং
No comments:
Post a Comment