Wednesday, February 8, 2017

বিত্তশালী বা ডিগ্রিধারী নয়, প্রয়োজন প্রকৃত মানুষ

এখন আধুনিক যুগ। মানব সভ্যতা এখন উৎকর্ষতার চূড়ায়। বিজ্ঞান এমন সব কান্ড করে দেখাচ্ছে যা কয়েক দশক আগে মানুষ কল্পনাও করতে পারে নি। উপরন্তু রয়েছে বিশ্বায়ন, চলছে তথ্য প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ। এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী, এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বাস্তবায়িত হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশ নামের রূপকল্প। বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি আধুনিকতা, উন্নতির ছাপ। 

আদিম কালের মানুষ ছিল অসভ্য, আধুনিক কালের মানুষরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করে। আসলে আমরা অনেকটাই সভ্য তবে পুরোপুরি সভ্য বলে নিজেদের দাবি করার সময় এসেছে বলে আমি মনে করি না। আমি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কথা বলছি। কিছু বাধা আমাদের সভ্য বলে দাবি করার পথে অন্তরায়। জাতি হিসেবে আজ আমরা অনেকটাই আধুনিক, অনেকটাই হয়তোবা উন্নত, অনেকটাই হয়তোবা শিক্ষিত। আমাদের সমাজে আছেন অনেক বিত্তশালী, আছেন অনেক বড় বড় ডিগ্রিধারী, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের এই সভ্য সমাজে প্রকৃত মানুষ আছেন কয়জন?

প্রকৃত মানুষ এর বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করি। হাত, পা, চোখ, কান ইত্যাদি তথা মানুষ এর আকৃতি থাকলে তাকে হয়তো মানুষ বলা যায়, তবে তাকে কি প্রকৃত মানুষ বলা যায়? যে মানুষটি আত্মকেন্দ্রিক, যে মানুষটি স্বেচ্ছাচারী, মিথ্যাবাদী, চরিত্রহীন, দুর্নীতিবাজ, যে মানুষটি নিজ ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলেন না, যে মানুষটি লোভী, দেশপ্রেমহীন, ঘুষখোর, স্বার্থপর, নির্লজ্জ, মাদকাসক্ত, যে মানুষটি পরিবার, সমাজ ও দেশের প্রতি দায়িত্ববান নন, যে মানুষটি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন তাদের কি প্রকৃত মানুষ বলা চলে? উল্লেখিত বিষয়গুলো কি সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ এর বৈশিষ্ট্য হতে পারে? এখন বলুন কয়জন প্রকৃত মানুষ আছে আমাদের এই সভ্য সমাজে? 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হচ্ছে মানুষ তৈরির কারখানা আর শিক্ষক হচ্ছেন মানুষ তৈরির কারিগর। কিন্তু বর্তমানে 'মানুষ' বলতে কি বোঝানো হচ্ছে? বর্তমানে মানুষ হওয়া বলতে বোঝানো হচ্ছে বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা এখন শিক্ষার্থীদের ভাল করে লিখাপড়া করতে বলেন, ভাল করে লিখাপড়া করলে ভাল বেতনের চাকুরী পাওয়ার স্বপ্ন দেখান। শিক্ষার্থীদের লিখাপড়া শিখে প্রকৃত মানুষ হওয়ার স্বপ্ন ক'জন শিক্ষকই দেখান? কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানতো আরো বেশ কয়েকধাপ এগিয়ে আছে। ওইসব আধুনিক, নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাচ্চাকে পড়ালে বাচ্চা বড় হয়ে নিশ্চিত বড়-সব ডিগ্রি অর্জন করবেই মর্মে নিশ্চয়তা দিয়ে ওই সব প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থী ভর্তি করায়। শিক্ষকরা সেখানে জ্ঞান বিক্রি করেন আর শিক্ষার্থীরা বাবা মায়ের টাকায় চড়া মূল্যে সে জ্ঞান কিনে নেয়। শিক্ষার্থী প্রতিদিন কি পরিমান জ্ঞান গিলতে পারল সেটাই এখানে বিবেচ্য বিষয়; নীতি নৈতিকতার আলোচনা মূল্যবান সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ডিগ্রিধারী এবং ভবিষ্যৎ এর বিত্তশালী তৈরি হচ্ছে, প্রকৃত মানুষ তৈরি হচ্ছে না।

আজকালকার অভিভাবকরা অনেক বেশি সচেতন। টার্গেট একটাই, ছেলে/মেয়ে অবশ্যই ভাল ফলাফল করতে হবে; অন্যকথায় জিপিএ ৫ পেতেই হবে। কিভাবে পেল বা কতটুকু যোগ্য তা বিষয় নয়, প্রয়োজনে শিক্ষক বেটে তাকে খাওয়ানো হবে; কথা একটাই জিপিএ ৫ পেতেই হবে। আমার হাসি পায় যখন শুনি, একটি ছেলে বা মেয়ে জিপিএ ৫ নিশ্চিত করার জন্য ধর্ম বা কর্মমুখী শিক্ষার মত বিষয়ে প্রাইভেট পড়ছে। শিশু শ্রেণি থেকেই অভিভাবকরা একটি ছেলে/মেয়েকে এতটাই পড়ার চাপে রাখে যে ওই ছেলে/মেয়েটি মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে বেড়ে উঠে। সামাজিকতা, পরোপকার, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ওই ছেলে/মেয়েটি অন্ধকারেই থেকে যায়। এই ছেলে/মেয়েটি বড় হয়ে একজন প্রকৃত মানুষ হবে এটি ভাবা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। আমাদের বাংলাদেশ ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। আর হয়তো বেশিদিন বাকি নেই, যেদিন আমরা উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে স্থান করে নিতে পারব। তবে আমাদের এই অগ্রযাত্রায় কোথায় যেন একটা পিছুটান আছে; কি যেন আমাদের অগ্রযাত্রাকে পিছন থেকে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করে সবসময়। তা আর কিছু নয়, তা হচ্ছে প্রকৃত মানুষ এর অপ্রতুলতা। একবার চিন্তা করে দেখুন, আমরা যদি ঘুষ, দুর্নীতি, আত্মকেন্দ্রিকতা, দেশপ্রেমহীনতা, চারিত্রিক দুর্বলতা, অন্যায় মেনে নেওয়া, স্বেচ্ছাচারিতা, শিক্ষার বানিজ্যিকিকরন এবং মাদককে আমাদের সমাজ তথা দেশ থেকে বিদায় করতে পারি তাহলে আর কি লাগে আমাদের? আরে কে রুখবে আমাদের অগ্রযাত্রা?

প্রকৃত মানুষ তৈরির প্রধান দায়িত্ব নিতে হবে বাংলার প্রতিটি পরিবারকে, ভূমিকা রাখবেন শিক্ষক সম্প্রদায়। কে বলে আমরা পারি না? আমরাই পারি, আমরাই পারব। ভুলে গেলে চলবে না আমরা বীরের জাতি, আমরা অসাধ্যকে করি সাধন, আমরা গড়তে পারি নতুন প্রাঙ্গন।

----------------------------------------------

লেখাটি ৯/০২/২০১৭ তারিখে mirsaraitribune এ প্রকাশিত হয়।

Post Comment

No comments:

Post a Comment