ভাল থেক ভালবাসা।
রাতুলের শেষ কথা। মেঘা কোন উত্তর দিল না। শুধু কিছুক্ষণ পর রাতুলের ম্যাসেঞ্জারে মেঘার নামের পাশে জ্বলতে থাকা সবুজ বাতিটি নিভে গেল। মেঘা নামটাও অস্পষ্ট হয়ে গেল। তরঙ্গ জগতে যদিও দুটি আই.ডি. বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, বাস্তবে কি দুটি মনের সম্পর্কের ইতি হয়েছিল?
রাতুল ও মেঘা পূর্ব পরিচিত। রাতুল ভাল ছাত্র; স্বভাবে শান্ত, ঘরকুনো, বন্ধুবান্ধব হাতেগোনা ২/৪ জন। এসএসসি'র গণ্ডি পেরিয়ে মাস ছয়েক আগে কলেজ জীবনে পদার্পণ করেছে। স্কুল-বাসা-স্যারের বাসা আর বিকেলে কিছুক্ষণ খেলার মাঠ। রাতুলের দিনগুলো এভাবেই কেটে যাচ্ছিল। মেঘা এবার নবম শ্রেণিতে উঠেছে। লিখাপড়া তার যতটা না ভাল লাগে, তার চেয়ে বেশি ভাল লাগে হৈ চৈ করে বান্ধবীদের সাথে সময় কাটাতে, অনেকটা ডানপিটে স্বভাবের মেঘা; ঠিক রাতুলের বিপরীত। একই স্কুলে পড়ায় এবং একই পাড়ায় থাকায় রাতুল ও মেঘার মাঝেমাঝে দেখা হত। প্রায়সময় রাতুল লক্ষ করত তাকে দেখলেই মেঘা তার বান্ধবীদের নিয়ে রাতুলের প্রতি কিছু একটা ইঙ্গিত করে উচ্চস্বরে হেসে উঠত এবং কি কি যেন বলত। রাতুল ওসব বুঝে উঠতে পারত না। হাঁটতে হাঁটতে মেঘা ও তার বান্ধবীদের সশব্দ হাসির কারন উৎঘাটনের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে রাতুল বরং নিউটনের ৩য় সূত্রের উপযোগিতা নিয়ে ভাবনার জগতে হারিয়ে যেত।
এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে রাতুল ফেসবুক ব্যবহার শুরু করে। কয়েকদিন পরই রাতুল মেঘার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পেয়ে একসেপ্ট করে। মেঘাই প্রথম ম্যাসেঞ্জারে ব্যক্তিগতভাবে রাতুলের সাথে আলাপচারীতা শুরু করে। প্রথমদিকে মেঘা পদার্থ, গণিতসহ বিভিন্ন বিষয় বুঝার জন্য রাতুলের সহযোগিতা চাইত। রাতুলও খুশি মনে মেঘাকে বিভিন্ন জটিল সমীকরণ সহজ নিয়মে বুঝিয়ে দিয়ে মনস্তুষ্টি লাভ করত। তবে এই ধারা বেশিদিন বজায় রইলনা। ম্যাসেঞ্জারে দু'জনের আলাপকাল ক্রমশ বাড়ছিল, তবে সেই আলাপচারীতায় অংকের সমীকরণের চর্চা ক্রমাগত কমে গিয়ে মনের সমীকরণের চর্চা প্রাধান্য লাভ করছিল। একসময় মনের সমীকরণ মিলে গেল; দু'জনের ভাব হল এবং এক নতুন অধ্যায়ের শুরু হল।
রাতুলের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে, সে এখন কলেজ পড়ুয়া ছাত্র। সুযোগ পেলেই মোবাইল নিয়ে বসে যায়। সবার আগে ম্যাসেঞ্জারে ঢুকে দেখে মেঘা নামটির পাশে সবুজ বাতি জ্বলছে কিনা। অন্যদিকে মেঘাও নিজের নামের পাশে সবুজ বাতি জ্বালাতে হন্য হয়ে সুযোগ খুঁজে। কিছু অভিমান, কিছু অনুযোগ আর বেশকিছু ভালবাসা; যেন স্বপ্নময় এক পৃথিবী। দু'জন দু'জনাকে সবসময় অনুভবে পাশে পেতে মরিয়া হয়ে থাকে। প্রথম প্রেম বলে কথা!
সময় এগিয়ে যায়, নদীর জল বয়ে যায়, প্রতিদিন ভোর হয়, পূর্ণিমা রাতের ভরা চাঁদের আলোয় পৃথিবী ধুয়ে যায়। ইদানীং মেঘার নামের পাশে সবুজ বাতিটি তেমন একটা আর জ্বলে না। রাতুলও মাস তিনেক আগে যেভাবে ওই সবুজ বাতি জ্বলে উঠলে হাতে পূর্নিমার চাঁদ পাওয়ার অনুভূতি পেত, তা আর পায় না। দু'জনের আলাপচারীতা চলে ঠিকই, তবে তা দিনভিত্তিক নির্দিষ্টহারে কমতে থাকে। মনের টানের চেয়ে নিয়ম রক্ষাই এখন যেন মুখ্য! অভিমানগুলো আজকাল অভিযোগে রূপ নিচ্ছে আর ভালবাসাগুলো বুকের খাঁচার শিকল ভেঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসার সাহস হারাচ্ছে। মূল্যবান সময় নষ্ট করার অনুভূতি দু'জনের মনে জেগে উঠছে। রাতুল ধীরে ধীরে পাঠ্যাভ্যাসে মন দিতে থাকে আর মেঘা দূরে সরিয়ে দেয়া বান্ধবীদের আবার কাছে টেনে নিতে থাকে। দু'জনই প্রয়োজন অনুভব করে কিন্তু কঠিন বাস্তবতাটা রাতুলের আঙ্গুলের ছোঁয়ায় বেরিয়ে আসে, "ভাল থেক ভালবাসা।" তাদের চোখের কোন্ বেয়ে একফোঁটা অশ্রু ঝরেছিল কিনা জানা যায় না, তবে দু'জনেরই বুকের অনেক গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
রাতুল ও মেঘা দু'জনই তের থেকে উনিশ বছর বয়সী। ইংরেজিতে যাদের বলে টিনএজার। এ বয়স প্রেমের বয়স নয়; এ বয়স আবেগের বয়স, এ বয়স মোহের বয়স। এ বয়সে একটি ছেলে বা মেয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না; জীবন সম্পর্কেতো নয়ই। রাতুল ও মেঘা হয়তো আবার অন্য কারো প্রেমে পড়বে, হয়তো আবার সম্পর্ক ছিন্ন হবে, হয়তো তাদের মনে বৈরাগ্য আসবে, হয়তো তারা পিছনের সবকিছু ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করবে, হয়তো পা বাড়াবে অন্ধকার জগতের দিকে, হয়তো হারিয়ে যাবে এই পৃথিবী থেকে, হয়তো....................।।
No comments:
Post a Comment