কয়েকদিন আগে রাস্তায় একজনকে দেখতে পাই। একা নয়; পুরনো বন্ধুরা সব সাথেই ছিল। মাঝ রাস্তায় অট্টহাসি সমেত সরব - সমবেত উৎফুল্লতা। কোন পরিবর্তন চোখে পড়েনি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। একেবারে কাছাকাছি এসে নিশ্চিত হয়ে চোখদুটো নিচের দিকে নামিয়ে চলে গেলাম। এর কিছুদিন পরই দেখতে পাই দ্বিতীয়জনকে। সে শার্টের উপরের দিকের দুটি বোতাম খুলে দিয়ে বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। রীতিমতো নিজের চোখের উপর অবিশ্বাস হলো। কিন্তু খুব কাছে আসতেই আমার অবাক নয়নে নয়ন রেখে সে যখন আমার কুশলাদি জানার আগ্রহে মুখ খুলছিল, তখনই অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে সোজা হেঁটে চলে গেলাম।
যেদিন গণধর্ষণের কথাটা কাগজে পড়ি, সেদিনই দুজনকে চিনতে পেরেছিলাম। বাচ্চা ছেলে দুজনই। ভয়াবহতা হচ্ছে, মেয়েটিকে ব্ল্যাকমেইল করে মাসের পর মাস দুজন মিলে ইচ্ছেমতো ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে প্রশাসনের সহযোগিতায় দুজনই হাতেনাতে ধরা পড়েছিল। মামলা হলো, দুজনই হাজতবাসী হলো; আমরা মনে মনে শান্তি পেলাম।
এ ঘটনার আগে তারা পনের-বিশ জনের সংঘবদ্ধ গ্রুপ হয়ে চলাফেরা করতো। উল্লেখিত দুজনের একজন ছিল ওই গ্রুপের মূল নেতা। ইভটিজিং ছিল এই গ্রুপের প্রতিটি সদস্যের নেশা। সকাল, দুপুর, বিকাল, এমনকি রাত দশটার পরেও তাদের বাজারে দেখা যেত। ধারণা করি, তাদের মা-বাবা তাদেরকে ভায় পায়। তাই তাদের উপর কোন পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা কতিপয় তথাকথিত বড় ভাইয়ের ঢাল হিসেবে তাদের আশ্রয়ে লালিত-পালিত হচ্ছিল। এককথায়, এক এক জন বাজারের রংবাজ হিসেবেই গড়ে উঠছিল; যারা ধরাকে সরা জ্ঞান করতে অভ্যস্ত ছিল না।
গণধর্ষণ মামলায় গ্রুপের দুই সদস্য গ্রেপ্তার হওয়ার পর পুরো গ্রুপের দৌরাত্ম্য লক্ষনীয়ভাবে কমে এসেছিল। ভেতরে ভেতরে আঁচ করতে পারছিলাম, সেই বড় ভাইরা আরো উপরের বড়ভাইদের সহযোগিতা নিয়ে এই দুই ধর্ষকের জামিন করানোর জন্য নীরবে কাজ করে যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ফলাফল এলো; জামিন হলো। তারা হাজত থেকে বের হয়ে আবার গ্রুপ চাঙা করা শুরু করেছে, দ্বিধাহীনভাবে বুকচেতিয়ে সদলবলে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে সাংগঠনিক সাইনবোর্ড তারা ব্যবহার করছে, সেই সংগঠনের এমন কোন সুবিবেচক-বোধসম্পন্ন কান্ডারী নেই, যিনি অন্ততঃ এই দুজনের ঘরে থাকা নিশ্চিত করতে পারেন? যারা জামিন করাতে পেছন থেকে নীরবে কাজ করেছেন,তারা? আমি একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তাদের এড়িয়ে চলছি, তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করছি; এটাই আমার প্রতিবাদ। কিন্তু আমাদের সমাজে সমাজপতি রয়েছেন, বর্তমান সময়ের অনেক হিট বড়ভাই রয়েছেন, সাংগঠনিক কান্ডারী রয়েছেন; তাদের তো আরো কিছু করার আছে। কেন তাঁরা দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছেন? এমন বেহায়াপনা, এমন নির্লজ্জতা, এমন দায়িত্বহীনতা নিয়ে কি একটি সমাজ টিকতে পারে?
গত দুমাসে বহুবার ওই দুই ধর্ষকের মুখোমুখি হয়েছি। নতুন উদ্যমে বাজার চষে সদলবলে আবার তারা রংবাজি শুরু করেছে। অত্যন্ত ঘৃণাভরে এড়িয়ে চলেছি।
আচ্ছা, তাদের যৌন লালসার তৃপ্তি ঘটাতে ওই মেয়েকে যখন তারা ডেকে পাঠাতো, তখন মেয়েটার কি মানসিক অনুভূতি হতো? দুটি ছেলে একজনের পর আরেকজন যখন একইস্থানে, একই সময়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করতো, মেয়েটির চোখ বেয়ে কি তখন জল পড়তো না? প্রতিবার ধর্ষিত হয়ে আসার পর আবার কখন ডাক পড়বে, এই ভয়ে কি মেয়েটি নির্ঘুম রাত কাটাতো না?
যারা বিভিন্নভাবে এই ধর্ষকদের পক্ষ নিয়েছেন, নীরবে, পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে তাদের সহযোগিতা করেছেন, এমনকি যাদের আশ্রয়প্রশ্রয়ে গণধর্ষণ মামলার জামিনে থাকা আসামী হয়েও তারা বুক ফুলিয়ে বাজারেঘাটে ঘুড়ে বেড়ানোর মতো লজ্জাহীন ও দুঃসাহসিক কাজ করে যাচ্ছে; তারা কি ভাবছেন? আপনাদের উপর অভিশাপ পড়বে না? অবশ্যই পড়বে। ওই ছোট্ট মা'মনির প্রতিক্ষণের মানসিক যন্ত্রণা, প্রতি ফোঁটা চোখের জল, প্রতিটি নির্ঘুম রাতের দীর্ঘশ্বাস অচিরেই বিষধর সাপের মতো দিনরাত আপনাদের বিদ্ধ করবে। এই সমাজে নৈরাজ্য তৈরি করার অধিকার সৃষ্টিকর্তা কাউকে দেননি।
> নষ্ট সমাজ
> প্রবাল ভৌমিক
> ০৯ জুলাই ২০২০
No comments:
Post a Comment