Friday, February 4, 2022

একটি স্টার ফিল্টার ও একটি বটবৃক্ষের অধিকার

 গাছটা হঠাৎ করেই কথা বলা শুরু করলো। চৈত্র মাসের দুপুর বেলা, কড়া রৌদে চারদিক বাদামী রঙ ধারণ করেছে, পানির অভাবে ফাঁকা জমি গুলো হা করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। দুপুরের খাওয়া শেষ করে একটা স্টার ফিল্টার জ্বালিয়ে দ্বীপ স্নিগ্ধ বাতাসে শরীর ভেজানোর আশায় বটতলায় এসে দাঁড়িয়েছিল। মিনিট খানেক পরেই গাছটা কথা বলে উঠলো। দ্বীপ অবাক হলো; এতো হওয়ার কথা নয়। তার তেত্রিশ বছর বয়েসে কখনো তো সে কোন গাছকে কথা বলতে দেখেনি! তবে সে শুনেছে; বইপত্রে পড়েছে একসময় নাকি গাছরা কথা বলতো, কবিতা আবৃত্তি করতো, নেচে-গেয়ে মাতোয়ারা হতো, কথার ফুলঝুরি ফুটিয়ে অন্যকে বিমোহিত করার পাশাপাশি নিজের ভাবনার রাজ্যের পালে হাওয়া লাগাতো গাছরা। কিন্তু সে তো অনেক..... আগের কথা; প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। গাছরা কথা বলতে ভুলে গেছে, এটাই তো স্বাভাবিক! তাহলে আজ এমন কি হলো, এই বটবৃক্ষ কেন হঠাৎ কথা বলে উঠলো! 

গাছটা বলে উঠলো, "তুমি আমার অধিকার খর্ব করছ।" অধিকার! ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে বট গাছটির দিকে তাকিয়ে রইলো দ্বীপ। এরপর হো হো করে উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো সে। হাসি সামলানোর চেষ্টা করতে করতে  বললো, অধিকার শব্দটি এখনো তোমাদের অভিধানে আছে! আমাদের প্রজন্ম তোমাদের কথা বলতেই তো দেখেনি, বিলুপ্ত হতে হতে কোনরকম জড়বৎ তোমরা টিকে আছ এই ধরণীতে। আর সেই তোমরাই অর্থাৎ তুমিই নাকি আজ অধিকারের কথা বলছো! যখন তোমাদের হাত পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল, তোমরা অধিকারের কথা বলেছিলে? যখন তোমাদের বইপত্র কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, যখন তোমাদের আবৃত্তির ছন্দ ছেদ করা হয়েছিল, তোমরা অধিকারের কথা বলেছিলে? যখন তোমাদের কাঁধের উপর থেকে মাথাটা সরিয়ে নেওয়া হলো, যখন তোমাদের চোখ দুটো উপড়ে নেওয়া হলো, যখন অসুরীয় ভয়ংকর চিৎকারে তোমাদের শ্রবণশক্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত কোমড় ভেঙে যখন তোমাদের মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছিল; তখন তোমরা নিজেদের অধিকারের কথা বলেছিলে? আজ তুমি অধিকারের কথা বলছো, ধিক তোমার প্রতি। তোমরা নিজেদের কথা ভাবোনি; তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কথাও ভাবোনি। 

হঠাৎ দ্বীপের খেয়াল হলো, আচ্ছা গাছটা কথা বলছে কি করে! এর তো মুখই দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি ব্যবহারহীন থাকতে থাকতে গাছদের বাগযন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে গেছে? জ্বালানো স্টার ফিল্টারে শেষ টান দিতে দিতে দ্বীপ বললো, অনেক কথাই তো বললে এবার তোমার মুখটা একটু দেখাও, দেখে নিজেকে ধন্য করি। গাছ এবার আর কোন কথা বললো না, কোন উত্তরও দিলো না। যেমনি মুখ লুকিয়ে ছিল; তেমনি মুখ লুকিয়েই থাকলো। বটবৃক্ষেরা হয়তো এভাবেই মুখ লুকিয়ে থাকবে অনন্তকাল! 

প্রবাল ভৌমিক, মীরসরাই, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ইং

Post Comment

মহাজনহাট জমিদার বাড়ি - বিলুপ্ত ঐতিহ্য

 চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই উপজেলার ৪নং ধুম ইউনিয়নের অস্তিত্বহীন ঐতিহ্য মহাজনহাট জমিদার বাড়ি। ১৯০৫ কিংবা ১৯০৬ সালে মৃত্যুবরণ করার পূর্ব পর্যন্ত রায়বাহাদুর গোলক চন্দ্র চৌধুরী এই বাড়িতে থাকতেন এবং এই এলাকার জমিদার ছিলেন বলে জানা যায়। জমিদারি প্রথা রহিত হওয়ার পর রায় বাহাদুর গোলক চন্দ্রের উত্তরসূরীরা এই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত এই জমিদার বাড়ির দুটি ঘরের অস্তিত্ব থাকার কথা জানা গেলেও বর্তমানে সরেজমিনে পরিদর্শন করে মহাজনহাট জমিদার বাড়ির কোন  চিহ্নই পাওয়া যায় নি; উক্ত জমিদার বাড়ির স্থানে গড়ে উঠেছে কিছু বসতি ও একটি পোল্ট্রি কমপ্লেক্স । 

 ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক রায় বাহাদুর খেতাব পাওয়া জমিদার গোলক চন্দ্র চৌধুরীর জীবন নিয়ে শোনা যায় নানা নাটকীয় ঘটনা। প্রাপ্ত তথ্য মতে জমিদার গোলক চন্দ্র চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেছিলেন বর্তমান ফেনী জেলার একটি দরিদ্র পরিবারে। তাঁর মা তৎকালীন সুর বংশীয় জমিদার বাড়িতে কাজ করতেন। গরু নিয়ে মাঠে গিয়ে একদিন গুপ্তধনের সন্ধান পান বাবু গোলক চন্দ্রের পিতা। বদলে যায় তাঁদের জীবন কাহিনী। ১৮৪৫ সালে ফেনী ছেড়ে মীরসরাই এর ধুম এলাকায় এসে জমিজমা কিনে বসবাস করতে শুরু করে গোলক চন্দ্রের পরিবার। 

চট্টগ্রামের অন্যতম বিদ্যাপীঠ 'চট্টগ্রাম কলেজ' প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দুই বছরের মাথায় অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলে জমিদার গোলক চন্দ্র চৌধুরী নগদ দশ হাজার টাকা অনুদান দিয়ে ১৮৭১ সালে উক্ত কলেজটি পুনরায় চালু করার ভূমিকা রাখায় বৃটিশ সরকার কর্তৃক তাঁকে রায় বাহাদুর উপাধি দেওয়া হয়।

জানা যায়, মীরসরাই এর ধুম এলাকায় বসতি স্থাপনের পর মহাজনী ব্যবসা করে অল্প সময়ের মধ্যে নিজেদের অর্থ-সম্পত্তি কয়েকগুণ বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন গোলক চন্দ্র চৌধুরীর পরিবার। গোলকেরহাট ও মহাজনহাট বাজার স্থাপনের পাশাপাশি চট্টগ্রামের কালিবাড়ি ও মাঝিরঘাট এলাকায় প্রচুর জমি কিনেন রায় বাহাদুর গোলক চন্দ্র। তাছাড়া রামগড়ে ছিল তাঁদের চা বাগান। সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে এলাকায় নির্মাণ করেছিলেন ডাকঘর, দাতব্য চিকিৎসালয় ও বিদ্যালয়।

অন্যদিকে চড়া সুদে মহাজনী ব্যবসা করা, প্রজা বান্ধব হয়ে না উঠা, নিজের প্রতিষ্ঠিত বাজার হতে অতিরিক্ত কর আদায় করা, মামলা দিয়ে জনসাধারণকে হয়রানি করাসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ শোনা যায় জমিদার রায় বাহাদুর গোলক চন্দ্রের বিরুদ্ধে। 

প্রায় দেড়শো বছর আগে নির্মিত মহাজনহাট জমিদার বাড়িটি একটি পুরাকীর্তি, হাজারো ঘটনার স্বাক্ষী এবং হতে পারতো আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কিন্তু বাংলাদেশের এমন আরো অনেক পুরাকীর্তির মতো এটিও আজ বিলুপ্ত। এভাবেই অযত্নে অবহেলায় হয়তো ভবিষ্যতেও হারিয়ে যাবে বাংলার অনেক পুরাকীর্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন।

প্রবাল ভৌমিক, মীরসরাই, ২ ফেব্রুয়ারী ২০২২ ইং

Post Comment

Saturday, May 8, 2021

মমতার বিজয় ও 'তিস্তা পানিবণ্টন চুক্তি'

তিস্তা নদীর উৎপত্তি ভারতের সিকিমে। সেখান থেকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তা বাংলাদেশে এসেছে। তিস্তা অন্য দেশ থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হওয়া নদীগুলির মধ্যে চতুর্থ সবচেয়ে বড় নদী। সেচ ও মৎস্য চাষে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তিস্তার প্লাবনভূমি বাংলাদেশের ২৭৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে।

বাংলাদেশ  প্রতিবছরের ডিসেম্বর থেকে মে মাসের মধ্যে তিস্তার পানির ৫০ শতাংশ ভাগ চায়। কারণ এসময়ে দেশে পানির যোগান সবচেয়ে কম থাকে। ফলে বাংলাদেশের কৃষকদের একাংশ জীবন-জীবিকা নিয়ে প্রবল সমস্যায় পড়েন। পানি সঠিকভাবে না পাওয়ায় বাংলাদেশের পাঁচটি জেলার ১ লক্ষ হেক্টর জমি আক্রান্ত হয়। 

১৯৮৩ সাল থেকে পানি নিয়ে দরাদরি চলছে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে। ২০১১ সালে একটি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি হওয়ার কথা ছিল ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে। যার সময়কাল ১৫ বছরের। সেই অনুযায়ী তিস্তার ৪২.৫ শতাংশে ভারতের অধিকার ও ৩৭.৫ শতাংশে বাংলাদেশের অধিকার উল্লেখ ছিল।

এই চুক্তির বিরোধিতা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে তা আর সাক্ষরিত হয়নি। ২০১১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে প্রস্তাবিত ঢাকা সফরও প্রথমে রাজি হয়ে এই চুক্তির বিরোধিতা করে শেষে বাতিল করে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বারবার তিস্তা চুক্তি করতে চাইলেও রাজি হননি পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর যেহেতু পানি বন্টনের বিষয়টিতে রাজ্যের উপরে নির্ভরশীল কেন্দ্র, তাই মমতার সম্মতি ছাড়া তিস্তা পানিবণ্টন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে না।

‘সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার প্রেক্ষিতে’ তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি চূড়ান্ত করা হবে বলে বরাবরের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতেও আশ্বাসের বাণী শুনিয়ে গেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু এবারও পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভায় মমতার পুনঃজয়ে তিস্তা চুক্তি নিয়ে খুব বেশি আশা নেই বলেই ধারণা করা যায়।

Post Comment

Wednesday, April 21, 2021

অভিজ্ঞতা

 ধরুন, বাড়িতে কাঁচা আমের টক রান্না করা হয়েছে। আপনি আপনার ৪/৫ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে টক খেতে বসেছেন। আপনাকে টক পরিবেশন করা হলো একটি বাটিতে করে; আপনার ছেলেকেও একটি বাটিতে করেই পরিবেশন করা হলো কিন্তু তার বাটির নিচে একটা প্লেটও দেওয়া হলো।


কারণটা সিম্পল। আপনি চামুচ দিয়ে সহজেই বাটি থেকে আমের টক খেতে পারবেন কিন্তু আপনার বাচ্চা খেতে গিয়ে এদিক-ওদিক ফেলতে পারে; এমনকি বাটিটা উল্টেও দিতে পারে। তাই তার বাটির নিচের প্লেটটি এক্সট্রা প্রোটেকশন। কিন্তু যে কাজ আপনি সহজেই করতে পারবেন, তাতে আপনার ছেলের এক্সট্রা প্রোটেকশন লাগছে কেন? উত্তরটা হলো 'অভিজ্ঞতা'।


আপনি আপনার জীবনে চামুচ দিয়ে অনেক আমের টক খেয়েছেন, প্রথম প্রথম আপনিও নিখুঁতভাবে খেতে পারতেন না কিন্তু খেতে খেতে আপনি বুঝতে পেরেছেন বা আপনার বোধোদয় ঘটেছে কিভাবে কোনরকম এক্সট্রা প্রোটেকশন ছাড়া নিখুঁতভাবে কাঁচা আমের টক খাওয়া যায়। কিন্তু এমন হলো, আপনি এখনও আমের টক খাওয়ার সময় কাপড়চোপড়ে ফেলে দেন বা মাঝেমধ্যে বাটিও উলটে দেন। যদি হঠাৎ দু'একবার এমন হয়, ধরে নেয়া যাবে অসচেতনভাবে আপনি ভুল করে ফেলেছেন। কিন্তু যদি হরহামেশাই আপনি এমন কান্ড ঘটান, তাহলে ধরে নিতে হবে আপনার বয়স হয়েছে ঠিকই কিন্তু আপনি শিক্ষা অর্জন করতে পারেননি অর্থাৎ আপনার অভিজ্ঞতার ভান্ডারকে আপনি সমৃদ্ধ করতে পারেননি। অভিজ্ঞতাহীন জীবন ব্যর্থতার চূড়ান্ত রূপ।


এখানে 'চামুচ দিয়ে কাঁচা আম খাওয়া' রূপক অর্থ বহন করছে। মূল বিষয় হলো আমরা যদি সময় থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করি, অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ না করি এবং সে অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারি; যথেষ্ট বয়স বাড়ার পরও আমাদের সাথে অবলা বাচ্চাদের কোন পার্থক্য থাকবে না।

Post Comment

Sunday, April 18, 2021

মানসিকতা!!!

 একবার একজন গাড়ির কোম্পানির সাথে বসে বসে গল্প করছিলাম। একপর্যায়ে তাকে বললাম- ভাই, ভালো গাড়ি টাড়ি পেলে জানাবেন; আপনাদের মতো ব্যবসাবাণিজ্য কিছু করতে পারি কিনা দেখি। সে উত্তরে আমাকে বললো- ভাই, লুঙ্গি কোমরের উপর তুলে মানুষের মা'কে গালি দেওয়ার অভ্যাস আছে? অবাক চোখে তাকিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম- কেন ভাই? সে বলল- ভাই, লুঙ্গি কোমরের উপর তুলে মানুষের মা'কে গালি দেওয়ার অভ্যাস না থাকলে এ ব্যবসা করতে পারবেন না। ড্রাইভার আর স্টাফরা ডেইলি তিনবার করে আপনাকে বেচে চারবার করে কিনবে; লাভতো কিছু হবেই না বরং জমাজাটি যা আছে বছরখানেকের মধ্যে শেষ করে খালি পায়ে ঘরে ফিরতে হবে। 'লেবার ফাংশন' এতো সহজ না ভাই; সে যুক্ত করলো।

আমার পরিচিত একজন লোক 'মীরসরাই ইকোনমিক জোন'- এ 'লেবার' সাপ্লাই দেয়। একদিন কথা প্রসঙ্গে তাকে বললাম- ভাই, টাকা পয়সা তো ভালোই কামাচ্ছেন। উত্তরে সে বললো- ভাই, টাকা পয়সা কামাচ্ছি, ঠিক আছে। তবে বুঝেন তো ভাই 'লেবার ফাংশন'; অনেক ঝামেলা, সুখ নাই। আমি আবার বললাম- কি বলেন, ভাই? কাজ তো করে ওরা, আপনি তো কমিশনের মালিক। আপনার আবার ঝামেলা কিসের? উনি উত্তর দিলেন- ভাই, এটা ছাত্র পড়ানো না, এটা 'লেবার ফাংশন'; এইসব ছোটলোকদের নিয়ে কাজ করতে অনেক ঝামেলা আছে।

সিনিয়র একজন ভাই একটা অফিসে বড় পদে চাকুরী করেন। একদিন উনার অফিসে গিয়ে উনার অনুপস্থিতিতে অফিসের পিয়নের সাথে খুব গল্প শুরু করে দিলাম। গল্প চলতে চলতে আমি ও সেই পিয়ন দু'জন একে অন্যকে ভাই বলে সম্বোধন করছিলাম এবং খুব মন খুলে হাসছিলাম। এমন সময় বড় ভাই আসলেন, পিয়ন রুম থেকে চলে গেল, বড় ভাইয়ের সাথে এই-সেই কথা হচ্ছিল। একপর্যায়ে বড় ভাই বললেন, পিয়ন-টিয়ন এরা হলো 'লেবার' শ্রেণির লোক, এদের বেশি আস্কারা দেওয়া ঠিক না; মাথায় উঠে যায়। ওদেরকে ওদের অবস্থানেই রাখতে হয়- বড় ভাই যোগ করলেন।

এমন হাজারো উদাহরণ আছে। আমি এমনও দেখেছি, কিছুদিন আগে 'লেবার' থাকা লোকটি একটু ভালো অবস্থানে পৌঁছে তার অধীনস্থ 'লেবার' শ্রেণির লোকদের সাথে 'লেবার ফাংশন' এর মতোই আচরণ করেছেন। নিজের অতীত তাকে এতোটুকু কোমল করতে পারে নি।

মূলতঃ আমরা সবাই 'লেবার' কারণ সবাই কারো না কারো অধীনে কাজ করি। আমরা যার অধীনে কাজ করি সে আমাদের 'লেবার' ভেবে 'ডোমিনেট' করে আবার আমাদের অধীনে যারা কাজ করে তাদের আমরা 'লেবার' বানিয়ে 'ডোমিনেট' করি। আমি একবার একটা স্কুলে গিয়ে দেখেছিলাম, প্রধান শিক্ষক নিজে স্কুল ফান্ড থেকে নিয়মিত নাস্তা করেন কিন্তু অন্যান্য শিক্ষকদের নাস্তা করতে হয় নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। অর্থাৎ প্রধান শিক্ষক এক্ষেত্রে অন্যান্য শিক্ষকদের 'লেবার' হিসেবে গণ্য করে স্কুল ফান্ড থেকে তাদের নাস্তা করার অধিকার হরণ করেছেন। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে লক্ষ্য করলে এমন 'ডোমিনেটিং চিত্র' চোখে পড়ে। 

তবে সাধারণত 'লেবার শ্রেণি' বলতে আমরা যাদের জানি, তারা একেবারে নিচের পর্যায়ে অবস্থান করে। সকল উৎসের পানি নিচের দিকে গড়াতে গড়াতে সর্বশেষ তাদের উপর গিয়েই সর্বসাকুল্যে পতিত হয়। ফলে তারা 'মোস্ট ডোমিনেটেড'।

নিজ নিজ মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। কে কি করলো না করলো, তা না ভেবে আমরা নিজেরা কি করছি; তা নিয়ে ভাবতে হবে। আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনা বা সুযোগ বা পরিবেশ এখন আর নেই বললেই চলে; নিজের বিবেক দিয়ে নিজেকে ভালোর পথে পরিচালিত করতে হবে। মনের পশুত্বকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। এভাবেই হয়তো একদিন সমাজে ঘটে যাবে এক নীরব বিপ্লব। 

আমাদের আশেপাশে কয়জন আছে- যারা দূর্বলের উপর 'ডোমিনেট' করে না? 'লেবার শ্রেণি'কে তাদের প্রাপ্য অধিকার দেয়? 'লেবার'দের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য করে? ঘাম শুকানোর আগে 'লেবার' এর পাওনা পরিশোধ করে? সংখ্যাটা খুব কম। কিন্তু মুখে বড় বড় বুলি আওড়ানোর লোকের অভাব নেই। কিন্তু বাস্তবে 'লেবার' হলো আমাদের কাছে একধরণের জঘন্য, নিচু, অস্পৃশ্য, নিকৃষ্ট শ্রেণির কিছু মানুষ। এ ধারণা নিয়েই বেড়ে উঠছে আমাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম। 

কাল বাঁশখালীতে যা ঘটেছে, তা আমাদের দীর্ঘদিনের সামাজিক ব্যাধির ছোট্ট একটা ফলাফল মাত্র। এমন আরো অনেক ঘটনা নিয়মিত ঘটছে এবং ভবিষ্যতে ঘটার যথেষ্ট কারণ রয়েছে বলে ধারণা করা যায়।  

'লেবার' হত্যার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

Post Comment

Saturday, April 17, 2021

আত্মসমালোচনা

 যারা বাধ্য হয়ে বা পেশাগত প্রয়োজনে বের হচ্ছেন, তাদের কথা ভিন্ন। তারা ঘর থেকে বের হন দুঃশ্চিন্তা নিয়ে, তাদের নিয়েও দুঃশ্চিন্তায় থাকে তাদের পরিবার। মনে মনে নিজেদের অপরাধী ভাবে এদের অনেকে। ভাবে, এমন কাজ বা চাকুরী না করে অন্যকোন পেশায় থাকলে এই ঘোর দূর্যোগে ঘর থেকে বের হতে হতো না, তার কারনে ঘরের অন্য সদস্যদের সুরক্ষা সেক্রিফাইজ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতো না। সারাদিন যতটা সম্ভব সাবধানতার সাথে দায়িত্ব পালন শেষে ঘরে ফিরে সম্ভাব্য সকল স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করার পরও তাদের নিজের কাছে একটা খুঁতখুঁতে অনুভূতি কাজ করে। কিন্তু এদের সংখ্যা কতো ভাগ? আর এদের কি সুযোগ বা মানসিকতা থাকে এখানে সেখানে বাউন্ডুলের মতো ঘুরে বেড়ানো? 


স্বাভাবিকভাবেই বেশিরভাগ মানুষ একালে প্রতিদিন বাজার-সদাই করে না। কেউ সপ্তাহে, কেউবা পাক্ষিকভাবে।


প্রায় প্রতিদিন ফেসবুকে দেখি, অমুক_তমুক নামক কিছু লোক অলিগলির বা বাজারঘাটের ছবি তুলে নিজের টাইমলাইন থেকে পোস্ট করে ক্যাপশনে কটাক্ষ বা ব্যঙ্গ করে লেখে, 'দেখুন কেমন চলছে লকডাউন।' বা 'এর নাম লকডাউন?' বা 'এমন লকডাউন দেওয়ার চেয়ে না দেওয়া কি ভালো নয়?' বা ' ব্যার্থ লকডাউন।' বা 'লকডাউন বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যার্থ।'

প্রশ্ন হলো, সে কেন ঘর থেকে বের হলো? তাকে কে এ দায়িত্ব দিয়েছে? সে কি লকডাউন নিয়ম ভঙ্গ করলো না? কোন কাজ থাকলে ছবি তোলায় মনযোগ না দিয়ে, দ্রুত কাজ শেষ করে ফিরে আসা প্রয়োজন ছিল না? সে তার পরিবারকে কোন উদ্দেশ্যে ঝুঁকিতে ফেললো? নাকি এধরণের লোকরা নিজেকে করোনার চেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে করে??


আত্মসচেতনতা ছাড়া কোন লকডাউন-ই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না; হোক সেটা শিথিল বা কঠোর। আর অন্যের সমালোচনার চেয়ে আত্মসমালোচনা বেশি জরুরি।

Post Comment

Wednesday, April 14, 2021

কপটতা

 সম্প্রতি নিউজফিডে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপন সম্পর্কিত কিছু মতপার্থক্য দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এক পক্ষের বক্তব্য হলো, এটি সকল বাঙালীর একটা সর্বজনীন উৎসব। অন্য একটি পক্ষের মতে, পহেলা বৈশাখ মোটেও কোন সর্বজনীন উৎসব নয় বরং এটি একটি ধর্মভিত্তিক নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের উৎসব। তাই ২য় পক্ষ কোনভাবেই রাষ্ট্রীয়ভাবে পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ উদযাপনের পক্ষে নয়।

বর্তমান প্রজন্মের একটা বিশাল অংশ ইতিহাস পড়ে না বা জানতেও চায় না। তারা কোন একটি আদর্শের অন্ধ ভক্ত হতে পছন্দ করে এবং ওই আদর্শকেই একমাত্র উপাস্য বলে মনে করে একটি কুয়ায় আবদ্ধ হয়। 

এবার আসি আসল কথায়। বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সাল থেকে প্রতি বৈশাখে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের জন্য সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বৈশাখী ভাতা প্রদান করে আসছে। এর অনুকরণে বেশ কিছু বেসরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানও মহাধূমধামে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের লক্ষ্যে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি বৈশাখে বৈশাখী ভাতা প্রদান করছে। 

উপরোক্ত ২য় পক্ষ অর্থাৎ যারা বাংলা নববর্ষকে সর্বজনীন বা নিজেদের উৎসব বলে মনে করেন না এবং বিশ্বাস করেন যে, এটি রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হওয়া উচিত নয়; কর্মক্ষেত্রে তারা কি বৈশাখী ভাতা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন? না, এপর্যন্ত এমন কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। এটা কি স্ববিরোধিতা নয়? যে উৎসবের অস্তিত্বই তারা বিশ্বাস করে না, সে উৎসব উদযাপনের জন্য ভাতা গ্রহণ করা কতটা যৌক্তিক? 

আর যারা এখনো শিক্ষার্থী এবং বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিরোধী দলের সদস্য, তারা শিক্ষাজীবন শেষ করার পর নিশ্চয়ই এমন কোন চাকুরী পেতে চাইবে না যেখানে বৈশাখী ভাতা দেওয়া হয়; সেটা যতই লোভনীয় চাকুরী হোকনা কেন!!!

Post Comment