Wednesday, July 26, 2017

আমার একাল

আমি এখন একজন মধ্যবয়সী। আমার একটা বলয় আছে। শৈশব, কৈশোর এ যারা আমার বলয়ে ছিল, তাদের অনেকেই এখন আমার বলয়ে নেই। তবে আমার মনে হয় মধ্যবয়সের বলয়টা অনেকটাই আবেগহীন, বাস্তবতা নির্ভর এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়।
২০০০ সাল পর্যন্ত আমি ছিলাম অনেকটাই ঘরকুনো; মা বাবার বাহুডোরেই ছিল আমার বিচরণ। তবে ২০০১ সালে আমার জীবনে অনেক বড় পরিবর্তন আসে। লিখাপড়ার সুবাদে ঘর হতে বের হতে হয়। এরপর লিখাপড়া শেষ করে চাকুরী, বাইরে বাইরেই জীবন কাটতে থাকে। সেই ২০০১ থেকে শুরু করে ২০১৩ সাল পর্যন্ত, টানা তের বছর। এরপর আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসা, তবে ততদিনে বয়স ত্রিশের কোটায়, অর্থাৎ মধ্যবয়সী হয়ে গেছি। এই তের বছরের ঘরের বাইরের জীবনে আমি অনেক আবার বলছি অ-নে-ক কিছু শিখেছি। আমি ভাগ্যবান এই তের বছরে অনেক মানুষের সংস্পর্শ পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সমাজের উঁচু শ্রেণি, মধ্যবিত্ত শ্রেনি, নিম্ন শ্রেণি - সর্বত্রই ছিল আমার বিচরণ। উল্লেখ্য যে, এদের মধ্যে আমি অনেক রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষক, কবি, সাংবাদিক, পেশাজীবীরও সান্নিধ্য পেয়েছি। সবাই যে খুব আলোকিত ছিলেন তা বলতে পারব না, তবে অনেক আলোকিত ব্যক্তিরই সান্নিধ্য আমি পেয়েছি তা নিশ্চিত করে বলতে পারব। আলোকিত মানুষ হিসেবে যাদের দেখেছিলাম তাদের এখনো স্মরণ করি, অনুসরণ করার চেষ্টা করি। তাঁদের হাসিমাখা মুখ, বিনয়, মার্জিত আচরণ, মেপে মেপে কথা বলা, বাচনভঙ্গি, পরমতসহিষ্ণুতা, ইতিবাচক চিন্তা চেতনা, প্রখর ধী-শক্তি সবকিছুই মুগ্ধ করতো আমাকে।
আমি পড়তে শিখেছি আমার বাবার কাছ থেকে। ছোটবেলায় আমার বাবা এত সুন্দর করে আমাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে পড়াতেন, অনেক কঠিন পড়াও আমার কাছে চমৎকার, মজাদার মনে হত। এরপর বাবার হাত ধরেই শুরু খবরের কাগজ পড়া। বাবা প্রতিদিনই ঘরে খবরের কাগজ নিয়ে আসতেন, খবরের কাগজ পড়তে উৎসাহিত করতেন, অনেক আগ্রহ নিয়ে পড়তাম আর অবাক হয়ে ভাবতাম সাংবাদিকরা / প্রতিবেদকরা কিভাবে এত সুন্দর করে শব্দের মালা গাঁথেন। প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম কখন খবরের কাগজ আসবে, কখন সেই শব্দের মালার অমৃত রস আস্বাদন করব। এক কথায় নেশায় পরিনত হয়েছিল খবরের কাগজ পড়া। একটু বড় হয়েই খবরের কাগজ পড়ার সাথে সাথে শুরু করেছিলাম বই পড়া। আমার প্রথম পড়া উপন্যাসটির নাম এখন আর মনে করতে পারি না তবে লেখক ছিলেন সমরেশ মজুমদার। তখন খুব সম্ভবত আমি ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এরপর থেকে শুরু। মীরসরাই পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় এক পরম সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন ৭ম / ৮ম শ্রেণিতে পড়ি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার এর বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র তখন বিদ্যালয় ভিত্তিক একটি কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। আমাদের বিদ্যালয় উক্ত কার্যক্রম এ অন্তর্ভূত হওয়ায় আমরা বেশ কিছু ভাল মানের বই পড়ার সুযোগ পেয়ে যাই। উক্ত সময়ে পড়া দু'টি বইয়ের নাম উল্লেখ করতে পারি। একটি আলবার্ট আইনস্টাইন, অন্যটি ঝিন্দের বন্দি। এসএসসি পরীক্ষা শেষ করার পর ধরেছিলাম 'শরৎ' কে। আহা! সে কি সুধা! যে এইসুধা, এই 'শরৎ' সুধা পান করেনি তার জীবনের পরিপূর্ণতা কোথায়? পল্লীসমাজ, দেবদাস, চরিত্রহীন, গৃহদাহ, বড়দিদি, দত্তা, পথের দাবী আর শ্রীকান্ত (৪ পর্ব) ; এখনো এক নিশ্বাসে বলে দিতে পারি অসম্ভব ভাল লাগা সেই বইগুলোর নাম। এছাড়া শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, হুমায়ুন আহমেদ, কাসেম বিন আবুবাকারদের লিখাও আমার হৃদয় ছুঁয়েছিল। এই মধ্যবয়সে এখন আর ওতো পড়া হয় না, ওই যে শুরুতেই বলেছি এই মধ্যবয়স আবেগ বর্জিত বরং বাস্তবতা নির্ভর। আসলে বই পড়তে হলে আবেগী হতে হয়। বই মানুষ এর আবেগকে বাড়ায়, কমায়, আবেগ নিয়ে খেলা করে। যেখানে আবেগ নেই, সেখানে বই পড়ার আনন্দ নেই। ফেসবুক এর কল্যানে ইদানীং মাঝে মধ্যে কিছু কিছু লেখালিখির চেষ্টা করি। অনেক কঠিন ব্যাপার শব্দের পিছনে শব্দ, বাক্যের পিছনে বাক্য জুড়ে দিয়ে কথার মালা গাঁথা। অনেক কষ্ট হয় দু চারটা লাইন লিখতে। অবাক হয়ে মনে মনে ভাবি কিভাবে সেই সব সাংবাদিক / প্রতিবেদকরা, সেই সব সাহিত্যিকরা অবলীলাক্রমে এই দুরূহ কাজটি সম্পাদন করতেন, তাঁদের লিখা দিয়ে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করতেন।
এখন আমি শিক্ষক। আমার প্রাণপ্রিয় ছাত্রছাত্রীদের আমি প্রায়শ উপদেশ দেই বেশি বেশি বই পড়ার জন্য, পাঠ্যবই এর পাশাপাশি অন্য বই পড়ার জন্য। আমার বক্তব্য হল, সুন্দর বাচনভঙ্গি ও সুন্দর লেখনশৈলী অর্জনে পড়ার কোন বিকল্প নেই। যে যত বেশি পড়বে সে তত ভাল বলতে পারবে, সে তত ভাল লিখতে পারবে। আর যারা না পড়েই বলতে যায় বা লিখতে যায়, দু লাইন শুনলেই বা পড়লেই শ্রোতা বা পাঠকের কাছে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। তাই ভাল বলতে চাইলে পড়তে হবে এবং ভাল লিখতে চাইলে পড়তে হবে। কারন মনে রাখতে হবে গায়ের জোরে বা জোর করে অনেক কিছু হওয়া গেলেও ভাল বক্তা বা ভাল লেখক কখনই হওয়া যায় না।
মধ্যবয়সটা যেহেতু বাস্তবতা নির্ভর, এই বয়সে মানুষের দায়-দায়িত্বও কিছু বেশিই থাকে। নিজের প্রতি দায়-দায়িত্ব, পরিবারের প্রতি দায়-দায়িত্ব, সমাজের প্রতি দায়-দায়িত্ব, বন্ধু বান্ধবের প্রতি দায়-দায়িত্ব, আত্মীয় স্বজন এর প্রতি দায়-দায়িত্ব এবং সর্বোপরি দেশের প্রতি দায়-দায়িত্ব। এই বয়স দায়িত্ব পালনের, এই বয়স সিদ্ধান্ত গ্রহনের। ঝগড়া করার, কারো পিছনে লাগার, মদ খেয়ে মাতলামি করার, দিবাস্বপ্ন দেখার বয়স এটি নয়।
সুন্দর, সার্থক, শান্তিময় হোক সবার জীবন।

Post Comment

No comments:

Post a Comment