নিতুলের কাছে মোবাইল ফোন নেই। না থাকাই স্বাভাবিক। মোবাইল ফোন এখনো সহজলভ্য হয় নি। এটি এখনো বিত্তবানদের আভিজাত্যের প্রতীক। নিতুল মফস্বলের মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তার সৎ, স্বল্পভাষী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পিতার পক্ষে তাকে মোবাইল ফোন কিনে দেওয়া অতি বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ে। নিতুল মা বাবার দোয়া নিয়ে শহরে এসেছে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের লক্ষে। চট্টগ্রাম কলেজের ইংরেজি বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে সে। বন্ধু রশীদের এক কাজিনের মাধ্যমে আগে থেকেই থাকার ব্যবস্থা পাকা করা হয়েছিল। চকবাজার এলাকায় একটা মেসে রশীদের কাজিন তালেব ভাই থাকেন। ওখানেই অনেক কষ্টে তিনি রশীদ ও রশীদের বন্ধু নিতুলের জন্য দুটি সিটের ব্যবস্থা করেছেন। রশীদ নিতুলের এইচএসসির সহপাঠী। সে কমার্স কলেজে ব্যবস্থাপনা বিভাগে ভর্তি হয়েছে। নিতুল চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর তার বাবা তার থাকা খাওয়ার ব্যাপারে উদ্বীগ্ন হয়েছিলেন। পরে রশীদের মাধ্যমে এমন সুব্যবস্থা হওয়ায় স্বস্তির নিঃস্বাস ফেললেন কারণ গঞ্জের দোকান বন্ধ রেখে চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে ছেলের জন্য মেস খুঁজে বেড়ানো তাঁর জন্য দুঃসাধ্য কাজই বলা চলে। যা হোক, বের হবার সময় মা বলে দিলেন- বাবা, পৌঁছে তোর মতিন চাচার দোকানে ফোন করে তোর বাবাকে খবর দিবি।
মেসে পৌঁছার পর তালেব ভাই সবার সাথে নিতুল ও রশীদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবাইকে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হল। সবাই ছাত্র। নিতুলের বেশি ভাল লাগল হাছান ভাইকে৷ হাছান ভাই সিটি কলেজের স্নাতক ৩য় বর্ষের ছাত্র। বড় লোকের ছেলে, বেশ বোঝা যাচ্ছে। হাতে নকিয়া ৩৩১০ মডেলের মোবাইল, সিল্কি চুলে বারবার হাত যাচ্ছে, নীল রঙের জিন্স আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পড়া। ভাল লাগার মতই ছেলে। নিতুল মনে মনে ভাবল শহরের ছেলেরা মনে হয় এমন স্মার্ট হয়। আস্তে আস্তে সেও এমন স্মার্ট হয়ে উঠার স্বপ্ন তার মনের কোনে উঁকি দিল। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল নিতুল। বিকেলে রশীদকে নিয়ে বের হল। চকবাজারের একটা ফোন ফ্যাক্সের দোকান থেকে মতিন চাচার দোকানে ফোন দিয়ে বাবার সাথে কথা বলল। চার মিনিট কথা বলে চল্লিশ টাকা বিল দিয়ে দু'বন্ধু মিলে চকবাজারে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়িয়ে মেসে ফিরল। তালেব ভাই এসে মেসের নিয়ম কানুন বুঝিয়ে দিলেন, খাওয়ার জন্য কিছু টাকা অগ্রিম জমা নিয়ে নিতুল ও রশীদকে 'মিল' এর সদস্য করে নিলেন। নিতুল তালেব ভাইয়ের সব কথা শুনছিল কিন্তু মনযোগ দিতে পারছিল না। আসলে সে মনে মনে হাছান ভাইয়ের সাথে দেখা করার সুযোগ খুঁজছে। তালেব ভাই কথা শেষ করে বেরিয়ে যাবার পর নিতুল ঢুঁ দিল হাছান ভাইয়ের রুমে কিন্তু হাছান ভাইকে পেল না। তাঁর রুমমেট জানালেন, আসতে দেরি হবে। পরের দিন ক্লাস শুরু হবে, রাত দশটায় খেয়ে নিতুল ঘুমিয়ে গেল।
প্রথম দিন ক্লাসে গিয়ে নিতুল পুলকিত হল। এতো বড় ক্যাম্পাস, এতো এতো শিক্ষার্থী, এতো বন্ধুত্বপূর্ন শিক্ষক; এ যেন এক স্বপ্নের বাগান। ক্লাসে বসে স্যারদের প্রেরণাময় বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হল নিতুল। নিয়মিত লেখাপড়া করে ভাল ফলাফল করার পণ করলো সে। এমনিতেই ভাল ছাত্র নিতুল, বরাবরের মত সেরাটা দিতে পারলে তার পক্ষে ভাল ফলাফল করা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। মেসে ফিরেই দেখা হল হাছান ভাইয়ের সাথে। হাছান ভাই মেসের গেটে দাঁড়িয়ে বাম হাতে নোকিয়া ৩৩১০ ফোনটা কানে লাগিয়ে কথা বলছেন আর ডান হাতের দুই আঙ্গুলের ফাঁকে বেনসন সিগারেট জ্বালিয়ে মাঝে মাঝে তা মুখে নিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছেন। নিতুল সামনে গিয়ে সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল; তার কাছে মনে হল যেন বলিউডের কোন নায়কের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। প্রায় মিনিট তিনেক পর কান থেকে ফোন নামিয়ে হাছান ভাই হাসি মুখে নিতুলের কুশলাদি জানলেন, কলেজে কোন সমস্যা হলে তাঁকে জানাতে বললেন এবং ধূমপান একটা খারাপ অভ্যাস জানিয়ে তা থেকে নিতুলকে দূরে থাকার উপদেশ দিলেন।
ক্লাস, বিকেলে একটু ঘুরতে বের হওয়া, রাতে পড়াশোনা, চার পাঁচ দিন পরপর মতিন চাচার দোকানে ফোন করে বাবার সাথে কথা বলা, দুই সপ্তাহ পরপর বাড়ি থেকে ঘুরে আসা; এভাবেই নিতুলের দিন কেটে যাচ্ছিল। তবে হাছান ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা ইদানিং বাড়ছে। বিকেল বেলায় এখন রশীদের সাথে তেমন একটা বের হয় না নিতুল। সুযোগ পেলেই হাছান ভাইয়ের সঙ্গী হয়। হাছান ভাইয়ের সাথে বের হওয়ার বেশ কিছু সুবিধা আছে। হাছান ভাই রিজার্ভ ট্যাক্সি নিয়ে চলাফেরা করেন, দামি হোটেলে সন্ধ্যায় নাস্তা করেন, তাঁর বন্ধুরা সব বিভিন্ন কলেজের প্রভাবশালী নেতা, মাঝে মাঝে নিজের মোবাইল ফোনটা নিতুলকে রাখতে দেন; ব্যাপারটাই অন্যরকম মনে হয় নিতুলের কাছে। খুব উপভোগ করে সে। আগে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে মেসে ফিরে পড়তে বসত নিতুল; ইদানিং হাছান ভাইয়ের সাথে বের হলে মেসে ঢুকতে ঢুকতে প্রায় রাত দশটা বাজে, খেয়েদেয়ে বইয়ে চোখ বুলাতে বুলাতে ঘুমিয়ে পড়ে নিতুল। সকালে উঠে আবার কলেজে যাওয়া এবং বিকেলে হাছান ভাইয়ের সাথে বের হওয়ার সুযোগ খোঁজা। হাছান ভাইয়ের মোবাইল থেকেই নিতুল এখন মতিন চাচার দোকানে ফোন দেয়। হাছান ভাই এখন নিতুলের খুব আপনজন। প্রতিদিনই সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত নিতুল হাছান ভাইয়ের সাথে সময় কাটায়। সামনে কেউ না থাকলে হাছান ভাইয়ের বেনসন এর শেষ এক-তৃতীয়াংশ এখন নিতুলেরই প্রাপ্য হয়। নিতুল নিজেও ইদানিং টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে ধোঁয়া কিনতে শুরু করেছে। পনের দিন পরপর এখন প্রায়শঃ আর নিতুলের বাড়ি যাওয়া হয় না। মা বাবাকে পড়ার চাপের কথা বলে মানিয়ে নেয় সে। ক্লাসেও আর নিয়মিত যাওয়া হচ্ছে না নিতুলের, সকালে সময়মতো উঠতে পারছে না নিতুল; ইদানিং রাতে সিগারেটের ধোঁয়ার পাশাপাশি অন্য ধোঁয়াও পেটে ঢুকছে। মাঝে মাঝে দেওয়ানহাট মোড়েও যেতে হচ্ছে হাছান ভাইয়ের সাথে।
এখন নিতুল হাছান ভাইয়ের আদর্শের ধারক। হাছান ভাইও অনেক খুশি নিতুলের মত এমন একনিষ্ঠ মেধাবী শিষ্য তৈরি করতে পেরে। দিনের চব্বিশ ঘন্টার পনের-ষোল ঘন্টাই এখন নিতুল কাটায় হাছান ভাইয়ের সাথে। দেড়-দুই মাস পরপর বাড়ি গেলেও খুব দ্রুতই আবার ফিরে আসে হাছান ভাইয়ের কাছে। এদিকে নিতুলের ১ম বর্ষ পরীক্ষার রুটিন প্রকাশিত হয়েছে, পরীক্ষার আর বাকি এক মাস। পড়াতো হয়নি তেমন কিছু। কি করা যায় তা নিয়ে হাছান ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করতে বসল নিতুল। সবকিছু শুনে হাছান ভাই গম্ভীরমুখে সিদ্ধান্ত দিলেন- এবার আর পরীক্ষা দেওয়ার দরকার নেই। এখন থেকে ভাল করে প্রস্তুতি নিয়ে একেবারে আগামীবার ভাল করে পরীক্ষা দেবে। বাসায় বলবে পরীক্ষা দিয়েছ। এবার তোমার দায়িত্ব আমি নিলাম।
হাছান ভাইয়ের এ সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল নিতুল। প্রতিদিন দুই ঘন্টা করে পড়ার প্রতিশ্রুতিও নিতুলের কাছ থেকে আদায় করলেন হাছান ভাই। পরদিন দুপুর বারোটায় ঘুম থেকে উঠল নিতুল। কলেজে যাওয়া হল না। সন্ধ্যায় হাছান ভাইয়ের সাথে বের হয়ে 'জাগা-অজাগা' ঘুরে মেসে ফিরল রাত বারোটার কিছু পর।
এভাবেই হাছান ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে আগামীবার পরীক্ষা দিয়ে ভাল ফলাফল করার স্বপ্নে কাটতে লাগল নিতুলের দিনরাত্রিগুলো!!!
No comments:
Post a Comment